রূপালি সৈকতে (১৯৭৯) : আলমগীর কবির

 



বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ইতিহাসে আলমগীর কবিরের রূপালি সৈকতে (১৯৭৯) মতো আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যভিত্তিক সিনেমা এবং কাহিনির্ধমী ছবির এমন জমাট উদাহরণ আর আছে কি না, জানা নেই। আবার বলা যায় এমন দক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রী, এতো উজ্জ্বল নক্ষত্রের মহা সম্মেলন আর কোন চলচ্চিত্রে ঘটেছে কি  না, জানা নেই। 

 

আলমগীর কবিরের জীবনী যতোটুকু ভাসা ভাসা জানি তাতে মনে হলো লেলিন (বিলেত শিক্ষিত সাংবাদিক, কমিউনিস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রনায়ক), কামাল (চলচ্চিত্রকার) আনোয়ার (প‍্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দলনের  ফিচার সাংবাদিক) এই তিন চরিত্রের সমন্বিত রুপই হলো আলমগীর কবির। জীবিত অবস্থায় আত্মজীবনী মূলক উপন‍্যাস অনেকে লিখেছেন। কিন্তু চলচ্চিত্র খুব কমই নির্মিত হয়েছে।

 

অনেক সময় ভেবে দেখলাম। রূপালি সৈকত নিয়ে বিশদ লিখতে গেলে একটি দেশের জন্মের ইতিহাস লিখতে হবে। একজন সৃষ্টিশীল সংগ্রামী মানুষের বেড়ে উঠার ইতিকথা লিখতে হবে। একটি কাঠামো ভেঙ্গে কাঠামো গড়া চলচ্চিত্রের আত্মকথা লিখতে হবে।

 

তবে দুটি দিক আমার মননকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। হয়তো বা এদুটি দিক নিয়ে আমিই বহুদিন ধরে ভেবে আসছি বলেই হবে। প্রথমটি হলো বাংলাদেশের জীবনে ভিন্ন জাতি বহুভাষার প্রভাব। মেসোপটেমিয়া উপন‍্যাসে এইদিকটি নিয়ে কাজ করা আমার এক ধরনের তপস‍্যাই বলা যায়। চলচ্চিত্র যেমন আরবি ইংরেজি উর্দু আর পাঞ্জাবী ভাষার ব‍্যবহার করা হয়েছে তেমনটা। এমন রেফারেন্স যে এই ছবিতে পাবো তা ছিলো অপপ্রত‍্যাশিত।

 

আরেকটা দিক হলো পশ্চিম পাকিস্থান পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিদের সাথে কিভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পাওয়া মার্শাল রেইস নাতির ভিত্তিতে রেসিজম বজায় রেখেছিল। মুলতানের পাঞ্জাবী ইন্টারোগেটর যখন লেনিনকে রিমান্ডে ফিল্ড মার্শাল আইউব খানের Friends Not Masters: A Political Autobiography [1967] বইটি পড়ছে কিনা জানতে চায়। তখন লেলিন  আইউব খানকে বাঙ্গালি বিদ্বেষী বলে অভিহিত করে। আর আমার মনে পড়ে যায় ২০২১ সালের বাংরাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী [৫০ বছর পূর্তি] উপলক্ষে একটি ইংরেজী প্রত্রিকার জন্য . . কে. নিয়াজীর The Betrayal of East Pakistan [1998] এর রিভিউ লিখি যাতে পাঞ্জাবীদের বাঙ্গালি জাতিবিদ্বেষর দিকে সামন্য ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। অন্য আরো কিছু দিকের সাথে বাঙ্গালি জাতিবিদ্বেষের বিষয়টি সম্পর্কে আপত্তি তোলেন। (Race had not yet surfaced as an issue in that context, but it mattered in the deep down, in every structure in the state.  [Is race really the issue here? It was more about ethnicity and religion, and as an extension, language and culture.) যদিও আমার লেখাটা ও এডিটরের মন্তব্য আরো একটু নিবিড়ভাবে পড়ে মনে হয়েছে আমি আরো প্রিসাইজ ও ক্লিয়ার করে লিখা দরকার ছিলো। আমার লেখার সীমাবদ্ধতাই সম্পাদক ও রিভিউয়ারকে বিষয়টির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদানে সক্ষম হয়নি।

 

তবে রিভাইজ করলে প্রকাশিত হবে নিশ্চিত করে। কিন্তু বছররে শেষে অফিসের বাড়তি চাপ ও সময় স্বল্পতার জন্য পুনরায় লিখা সম্ভবপর ছিলো না। আর আমি জানি সকল আপাত নিশ্চিত সিধান্তসমুহ এক একেকটা বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। যেমনলারকানা কন্সপাইরেসি, ”বাঙ্গালি জাতি বিদ্বেষ, ”হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল রিফিউজ এমনকি সবচেয়ে অনুমিত প্রচ্ছন্ন সত্য যা ব্যাপক গবেষনার দাবি রাখে তা হলো- ১৬ ডিসেম্বর ১৯১৭১ সালে পাঞ্জাবী নিয়াজী বাঙ্গালি ওসমানির কাছে নিয়মানুযায়ী সারেন্ডার করতে রাজি ছিল না যার মূলেও এই বাঙালিকে ছোট মনে করার একটা প্রবণতা ছিল। ফলে তিনি পাঞ্জাবী আরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় জেনারেল ওসমানি সারেন্ডারের সময় সিলেট থেকে ঢাকায় আসার পথে দুর্ঘটনার জন্য উপস্থিত পর্যন্ত থাকতে পারেন নি। এই ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ের একট বড় ট্র্যাজিডি বলে মনে হয়। মনে হয় এইকানে কোন ষড়যন্ত্র নয়তো। সকল অনুমিত সিধান্তগুলো নিয়ে একটা মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখার চিন্তা মাথার ভেতর সেই কবে থেকে খেলা করে।

 

রূপালি সৈকতে (১৯৭৯) একটা দিক আবারও মনে করিয়ে দেয় যে ইতিহাসের সব সত্য প্রামণ্য দলিলে পাওয়া যায় না। সত্য থাকে কিছু সৃস্টিতে কিছু কল্পনায়।

 

রূপালি সৈকতে (১৯৭৯)

আলমগীর কবির

বাংলা, বাংলাদেশ


Comments

Popular posts from this blog

বুনোহাঁস : পলাশ মাহমুদ

Shoeshine [1946] : Vittorio De Sica

The Gospel According to the New World : Maryse Condé