ঘরে বাইরে : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুরুতেই "মা গো, আজ মনে পড়ছে" এই বাক‍্যাংশটি যখন পড়লাম। তখন পড়িয়াছে এর পরিবর্তে পড়ছে ক্রিয়াপদ দেখে মনে হলো ভাষায় একটা প‍্যারাডাইম শিফট ঘটে গেলো। কিন্তু দ্বিতীয় বাক‍্যের শেষ অংশে "অরুণরাগরেখার" শব্দবন্ধনী পড়ে মনে হলো বঙ্কিমীয় সংযুক্তশব্দমালার আবহ থেকে মুক্ত হতে পারে নাই। তাই এই পরিবর্তনটাকে পুরোপুরি প‍্যারাডাইম শিফট বলা উচিৎ নয়। যদিও শব্দের এমন সুংযুক্তি আমার অত‍্যন্ত প্রিয়। কয়েক পৃষ্ঠা অন্তরে লক্ষ করলুম রবিবাবু তার চিরাচরিত নাট‍্যভঙ্গিমায় সংলাপরীতি কে বিদেশীপন‍্যের মতো আমূলে বর্জন করেছেন।


তখন থেকে বোধকরি ভাষার সাধু ও চলিতের মধ‍্যে ভারতীয় সাম্প্রদায়িক প্রকৃতির মতো করে  কে বেশি শুদ্ধ এই বিষয়ে একটা রেষারেষি শুরু হয়ে গেলো। এই যেমন এখনকার কালে ভাষার সমঝদারী সুবেদারগণ বাংলাদেশী বাংলা না ভারতীয় বাংলার আধিপত্য নিয়ে মাঝে মাঝেএকটা মানসিক দ্বন্দে কলহে লিপ্ত হয়ে যায়।


আমি তো বলি ভাষার বিচারে শুদ্ধতার কলকাঠি নাড়িয়ে মনকে কুলষিত করা একপ্রকার বাতুলতা। 


নারী ও পুরুষের প্রভেদের যে বাহাস বিমলা ও নিখিলেশ শুরু করেছে। তা বাঙলা রেনেসাঁ সৃষ্ট ভাব ও ত্বত্তবিধানের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই না।


ভারতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার অস্ত্র হিসাবে বাঙলায় স্বদেশী আন্দোলন কি গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পূর্বসূরি বলা যায়? 


দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের ভক্তি ও বিদ্বেষ সম্বন্ধে নিখিলেশ ও সন্দীপের মাঝে হেগেলীয় দ্বান্দিক যুক্তিতর্কের অবতারণা হয় তা এক কথায় অনবদ‍্য। এই রকম কূটতর্কে সারা বিশ্বদরবার এখন মাতোয়ারা।


সন্দীপের আত্মকথায় "আমার জন্মাবার আগেই যে আমার সৃষ্টি হয়ে গেছে; আমি তো নিজেকে বেছে নিতে পারি নি," উক্তিটি ইউরোপীয় ব‍্যাক্তিস্বতন্ত্রবাদীতার মূলকথা- existence precedes essence এই ধারনার প্রতিযুক্তি হিসাবে  উদ্ধৃত হয়েছে। ঐ সময় এই ভাবনাখানি অস্তিত্ববাদের প্রেরণা হিসাবে শিল্প সাহিত‍্যের ভুবনে শক্তভাবে প্রচলিত ছিল।


উপন‍্যাসে কাহিনীর দিকবিদিকের বৈচিত্র্যের চেয়ে চরিত্রদের মনোজগৎতের স্তরে স্তরে যে অভিঘাত বা দর্শনের আকিঁবুকিঁ বেশি। যার ফলে উপন‍্যাস শেষ পর্যন্ত আখ‍্যানের চাইতে বর্ণনাত্মক হয়ে উঠে। এই কৌশলখানি অনেক পাঠকের জন‍্য একদিকে ক্লান্তিকর হয়ে উঠে। অপরদিকে ভাব ও ভাবনার নতুনত্বে ও বৈচিত্র্যে পাঠকের মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না।


যদিও নিজেকে নিখিলেশ ভেবে স্বস্তি বোধ করবো; তবুও সন্দীপের মতো আমারও মনে হয় - পৃথিবীটা সত‍্যের চাইতে মিথ‍্যা দিয়ে গড়া বেশি। 


সত‍্য ও মঙ্গলের ধারনায় ভাববাদ ও বস্তুবাদের এমন বাচসা ঘরে বাইরের পূর্বে বাঙলায় বিবৃত হয় নাই। প্রেম ও সৌন্দর্যের রূপরেখা যদি ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝতে চাই তাহলে ঘরে বাইরে অবশ‍্য পাঠ‍্য। বোঝা গেল, ঘরে বাইরে লেখার পূর্বে রবি ঠাকুর দর্শনের সামগ্রিকতাকে শক্ত করে আয়ত্ত করেছিলেন।



📘ঘরে বাইরে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সবুজপত্র, ১৯১৬।

Comments

Popular posts from this blog

শুদ্ধ দেশ: পলাশ মাহমুদ

The 2020 Booker Long List: The Fresh List in the Time of Solitude

সে রাতে পূর্ণিমা ছিল শহীদুল জহির