নৌকাডুবি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পৃথিবীর দুইটা পীঠ একই সঙ্গে কেউ দেখিতে পারে না।  মানুষের এই অজ্ঞেয়তা আর সীমাবদ্ধতা আমাকে রমেশের দ্বিতল জীবনের স্বরূপটা যেন  এক নিমিষে চোখের সামনে প্রস্ফুটিত করিয়া তুলিল। সত‍্যি তো! মানুষের জীবনস্তর গুলো সমসময়ে অবলোকন করো সম্ভবপর হয়?

ক্ষত্রিয় বিবাহ প্রথার একটু ছৌট্ট উপকাহিনী যেন নৌকাডুবির সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক জিজ্ঞাসা নিয়া হাজির হইল।

অনির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে নিশ্চিত যাত্রার এক গভীর দার্শননিক কথোপকথন পাঠ করিলাম ২৮নং পরিচ্ছেদে।

জীবনকে স্রোতের মতো করিয়া বহিয়া নিতে হয়। স্রোত ধীর শ্লথ করিয়া দিলে, জীবনের ভার জমিয়া দীর্ঘ, উচু আর শক্ত হইয়া যায়। মুক্তভাবে বাচিঁবার প্রেরণা নিঃশেষ হইতে থাকে। ঠিক এই মর্মকথাই যেন নৌককাডুবির বাক‍্যাবলীর শৃন‍্যস্থানে খেলা খেলিতেছিল।

৪৩ পরিচ্ছদে প্রচলিত জীবন আচরণের গন্ডি পেরিয়ে ভিন্ন রীতি অবলম্বন করিলে, সমাজে কি যে একটা গোলযোগ বাড়িয়া যায় তাহারই এক সুস্পষ্ট দৃশ্যায়ন চিত্রিত হইয়াছে। বিশেষত ব্রাক্ষ্মসমাজের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেখিতে পাইলিম।

পুরুষের ন‍্যায় নারীকে যদি মুক্ত ও স্বচেতনায় বাড়িয়া উঠিতে দেয়া হয়। তাহইলে নারীও যে আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন স্বত্তায় রপান্তরিত হয় তাহার উপযুক্ত উদাহরণ হইলো কমলা।

উপন‍্যাসে দুটি পৃথক ঘটনার পূর্বাপর নয় বরং সমান্তররাল বর্ণনা কৌশল এখনো অবদি পরিদৃষ্ট হয় নাই। চেতনার প্রবাহে বর্ণনায় কিছুটা পাওয়া যায়। যদি কখনো ইহা সৃজন করা সম্ভবপর হয় তাহইলে একটা বৃহ‍ৎ আবিষ্কার হইবে।

কাহিনীতে নলিনাক্ষর আকস্মিক প্রবেশ ইহাকে চোখের বালির আঙ্গিকে ফেলিয়া দিল। রমেশ-কমলা-হেমনলিনী-নলিনাক্ষ যেন অতি সঙ্গোপনে মহেন্দ্র-আশা-বিনোদনী-বিহারী স্থলাভিষিক্ত হইলো। যুগলচরিত্র দ্বয়ের এমন সমানুপাতিক অদলবদলের পুনরাবৃত্তি কেমন সৃজনশীলতার অপচয় বোধ হইল।

তবে কাহিনী বিন‍্যাস, সংলাপ ও চরিত্রসমমূহের সংবেদনশীলতা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশে চোখের বালি হইতে নৌকাডুবি বহুলাংশে পরিপক্বতার পরিচয় দিয়াছে।

"আমি কমলা"- যেন আপ্তবাক‍্যের মতো মনে হইতে লাগিল। আত্মস্বত্বাকে অস্বীকার করিয়া বাচিঁয়া থাকা যে এক প্রকার মরণযাপন, এই সত‍্যই প্রতিইধ্বনিত হইতে লাগিল।

জগতের সকল স্বত্বা সত‍্য স্বীকার করুক এই কামনা রহিল।



📘নৌকাডুবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

১৯০৬।

Comments

Popular posts from this blog

Shoeshine [1946] : Vittorio De Sica

বুনোহাঁস : পলাশ মাহমুদ

Andaz [1949] : Mehboob Khan