রাজর্ষি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইউরোপীয় রেনঁসা যেরূপ রাষ্টকে চার্চ হইতে আলাদা করিয়াছিল। রাজর্ষিতে সেইরূপ রাজ্যকে ধর্মালয় হইতে মুক্ত করিয়া স্বতন্ত্র স্বত্বা দান করিবার প্রচেষ্টা করা হইয়াছে।
এই সম্বন্ধে রবীন্দ্র অত্যন্ত চমৎকার এক রূপকদৃশ্যর অবতারণা করিয়াছেন। যেন রাজা গোবিন্দমানিক্য তাহার ভ্রাতা নক্ষত্ররায়কে আলোকময় প্রাসাদ হতে অন্ধ অরণ্যে নিয়া গিয়াছিলেন। তেমনি পুরোহিত রঘুপতির শিষ্য জয়সিংহকে আরন্যক মন্দির হইতে প্রাসাদে নিয়া গিয়ািছলেন। সৌদামিননী যেমন আলো আর আধাঁরের সীমারেখাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া তোলে।
বৌদ্ধাচার বা আরকানরাজ্যের শাসনকে কেন মগের মুলুক (বৌদ্ধ্যরাজ্য) বলিয়া থাকে তা জানিলাম। সেকালে জীববলি সম্বন্ধে হিন্দুজাতি বৌদ্ধ ও মুসলমানদের আচারকে কেমন করিয়া কটাক্ষ করিতো তাহা বিস্ময়কর।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রাণীহত্যা নিয়া এমন স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থ উপাখ্যান কি বাঙলায় রবিবাবুই প্রথম উপস্থাপন করিয়াছিলেন? তাও আবার অমন তরুণ বয়সে। কী দুঃসাহস!
সুবাহবাঙলার চট্রগ্রাম ঢাকা কুমিল্লা ত্রিপুরা (বঙ্গ), পাটনা (বিহার), রাজমহল (ঝাড়খন্ড), বিজয়গড় (মধ্যপ্রদেশ), হইতে দিল্লী সালতানাথের অন্তিম পর্বের রাজকোন্দল নিয়ে এমন বৃহৎ ব্যাপ্তির ঐতিহাসিক উপন্যাস বাঙালায় বোধ হয় ইহাই প্রথম। কিন্তু ৪৩ পরিচ্ছেদে আসিয়া, শাহ সুজার সপরিবারে বঙ্গ প্রস্থান কাহিনি, জন স্টুয়ার্টের গ্রন্থ হইতে সরাসরি উল্লেখ বলিয়া যে স্বীকারোক্তি প্রদান করা হইলো, এই কৌশলখানি সাহিত্যিক শিল্পরস খানিক মলিন করিয়া তোলে। এই সম্বন্ধে রবীন্দ্র হইতে বঙ্কিম অধিক পরিপক্কতার পরিচয় দিয়াছেন।
শেষাংশে রাজা গোবিন্দ ও শাহ সুজা (রাষ্টের প্রতীক) ও পুরোহিত রঘু ও বিল্বনের (ধর্মের প্রতীক) মহাসম্মেলন একটু অতিনাটকীতায় পূর্ণ বলিয়া বোধ হইয়াছে।
বিল্বন ও গোবিন্দের জাতনিরপেক্ষতা অনেকটা লালনের মানবতাবাদে পুষ্ঠ বলিয়া সমরণ হইল। এই মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ হইয়া কি রবিবাবু শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন? এতোটা মানবতাবাদ সর্বব্যাপী কার্যকর হওয়া সম্ভবপর? যদি তাহাই হয় তাহলে এতো বৎসর পরও এই ২০২৩ সালে আসিয়া মহামতী অর্মত সেনকে বিশ্বভারতী ছাড়িয়া দিতে আইনি নোটিশ পাঠানো হইয়াছে। ইহা নিয়া তো এক মহাউপন্যাস সৃজন করা যাইতে পারে।
তবে যাই হউক, মানবপ্রেম ও প্রকৃতিভক্তি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এমন মনোরম ও চিত্তপ্রফুল্লকর ভাব ও বাক্যে আমি অভিভূত।
📘রাজর্ষি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বালক পত্রিকা,।১৮৮৭
Comments
Post a Comment