বৌ-ঠাকুরাণীর হাট : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুরুতেই একটু স্মৃতিচারণ করিবো। ইহা যে অতিবড় কাকতালীয় ঘটনা তাহা বারবার মনে উদয় হইতে লাগিল। রবিবাবুর বৌ-ঠাকুরাণীর হাট গন্থখানি, সেই শৈশবে স্কুলের টিফিনের টাকা বাচিঁয়ে কিনিয়াছিলাম। কিন্তু কি কারনে যেন পড়া হইয়া উঠে নাই। ক্রমে সন্ধ্যার আধারের মতো নিশ্চুপে চলিয়া গেলো দীর্ঘ বাইশটি বছর। এই বেলায় এসে আবার পড়িতে আরম্ভ করিলাম। সন্ধান লইয়া দেখিলাম, উপন্যাসখানি যখন প্রকাশিত হয়, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়সও বাইশে পর্দাপন করিঢাছিলো।

আরো দুইখানি দৈব অদৈব ঘটনা কেমন করিয়া যেন বৌ-ঠাকুরাণীর সাথে খানিক মিলিয়া গেল। গতকাল সকালে বৌ-ঠাকুরাণী প্রথামাংশ শেষ করিয়া, অফিসে যাইবার সময়  জানিতে পারিলাম, গাজীপুর শালনায় আমাদের জমির পূর্ব পাশের দেয়াল, পূর্বরাত্রির ঝড়ে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। তেমনি অফিস হইতে বাড়ি ফিরিয়া, রাতের আহার পর্ব শেষ করিয়া, বৌ-ঠাকুরাণীর অবশিষ্ঠ  অংশখানি পড়িয়া সমাপ্ত করিব বলিয়া মনস্থির করিয়াছি। এমন সময় জানিতে পাইলাম আমার বাড়ির সামনে প্রতাপাদিত‍্যের মতো রাজপ্রাসাদন‍্যায় বাড়িতে আগুন লাগিয়াছে। সমগ্রএলাকার সবার সম্মিলিত  প্রচেষ্টায় অনেক কষ্টের পর গৃহদাহ নির্বাপণ করিতে সচেষ্ট হইয়াছি। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, ধোয়াঁ আর ভষ্মের কারনে চোখ জ্বালা পোড়া করিতেছিলো। মাথাটাও কেমন ধরিয়া উঠিয়াছিল। তাই পড়া অসমাপ্ত রাখিয়া নিদ্রায় গিয়াছিলাম। আজ প্রভাতে নিদ্রভাঙ্গিলে, ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদে আসিয়া যখন "এদিকে আগুন খুব জ্বলিতেছে" বাক‍্যটি পড়িলাম তখন গতরাত্রের অগ্নিকাণ্ডের বিভীষিকার স্মৃতি মানসপটে নবজলের মতোই  ভাসিয়া উঠিল। আর আমার মন কেমন হু  হু করিয়া উঠিল।

বুঝিলাম জীবনে ভাঙ্গন, দহন বা পতন স্বাভাবিক। কিন্তু সৃষ্টি, প্রতিষ্ঠা  ও  উত্থানই মানুষর আরাধ‍্য‍।

এই এতাটুকু বয়সে, বঙ্কিমচন্দ্র শৈব্দিক ঐশ্যর্য হইতে মুক্ত হইয়া, মধুসূদনের বিরামচিহ্ন বিন্যাসকে অলক্ষে রাখিয়া, বোধকরি বাঙলায় সর্বসাধারণের জন্য সর্বপ্রথম সহজ কোন ভাষার আগমনী গান নিয়ে আবির্ভূত হইয়াছিলেন।

কিন্তু বঙ্কিমীয় কায়দায় সরাসারি পাঠককুলকে সম্বোধন করিয়া কাহিনী বর্ণনা কিংবা মদূসুদনীয় নাট্যসংলাপ ভঙ্গিতে সংলাপ গঠন করায় সামন্য অস্বস্তি বোধ করিয়াছি। অপরদিকে, বঙ্কিম ও মদুসূদন যেখানে ম্লেচ্ছদের শব্দবলীকে এড়িয়া যাইবার প্রবণতা লক্ষ করিয়াছি, সেখানে রবীন্দ্র যেন কাহিনীর প্রাসঙ্গিকে আরো বেশী করিয়া যেনো আলিঙ্গন করিয়াছেন। কিন্তু সকলের কাহিনীর বিষয়বস্তুতে ভারতীয়দের যবনবিদ্বেষ প্রকটভাবেই প্ররিস্ফুটিত হইয়াছে।

কোথাও কোথাও ঘটনার আকস্মিক লম্ফন, রহস্যরসের বিশৃংখল বিন্যাস দৃষ্টিকটু লাগিয়াছে। বিশেষকরে উপন্যাসের নামকরনের যথাযথ সার্থকতা খুজিয়া পাইতে মন:পীড়ায় ভুগিতে হইয়াছে। প্রতাপাদিত্যর মতো এমন চরিত্রও পাওয়া যায় এই ভুবনে, ভাবিয়া স্তব্ধ হইয়া ছিলাম। বিভা-রাম ও উদয়-সুরমার প্রনয়ভাব প্রকাশকে তরুণমনের উপযোগী করিয়া প্রণীত হইয়াছে।

মধুসূদন যেমন যতিচিহ্ন দিয়া যেরূপ শব্দকে করিয়াছেন প্রবাহমান।  তেমনি রবীন্দ্রনাথ যতিচিহ্ন উপযোগে বাক‍্যের প্রবাহকে করিয়াছেন সুষমামন্ডিত।

পনুশ্চে একটি কথাই বলিব- এমন তরুন বয়সে জীবন সম্পর্কে এমন পরিপক্কবোধ, সত্যি অসাধারণ!



📘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৮৮৩।

Comments

Popular posts from this blog

শুদ্ধ দেশ: পলাশ মাহমুদ

The 2020 Booker Long List: The Fresh List in the Time of Solitude

সে রাতে পূর্ণিমা ছিল শহীদুল জহির