উদয়ের পথে [১৯৪৪] : বিমল রায়

 






উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই

                                       -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনুপের ঘরের দেয়ালে অঙ্কিত।

 

১৯৪৩-৪৪- অখন্ড ভারতজুড়ে সে এক সময় যাচ্ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলন, বিশ্বযুদ্ধ, শীতল যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা আর দেশভাগের পূর্বরাগে উত্তাল উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম। এমন সময় শ্রী বিমল রায় বাংলায় নির্মাণ করেছেন উদয়ের পথে [১৯৪৪]। চলচ্চিত্র তৈরি একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। তাই একে ঠিক শুধুমাত্র সৃষ্টি, নির্মাণ, তৈরি কিংবা বানানো শব্দ দিয়ে ঠিক প্রকাশ করা যথাযথ মনে হয় না। সেই কবে থেকে একটা যর্থাথ শব্দের সন্ধানে আছি। ছবির পুরো সময়টা জুড়ে এর সংলাপের পিঠে সংলাপ গুলো শুধু বাংলায় নয় বরং সমগ্র বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ। তবে "এ অপমান শুধু তোর একার না। গরীব বলে যে জাতটা।।সেই সমগ্র জাতের।" মতো সাধরনীকরণ সংলাপের ব্যাপারে আমার বিরোধী মত আছে। 


ক্ষণে ক্ষণে উদয়ের পথের কাহানির ভাবে আইজেনস্টাইনের অক্টোবর ও ব্যাটলশিপ পটেমকিন এবং চার্লি চ্যাপলিনের সকল সিনেমার মেজাজের সাথে কেমন একটা সিনেমাটিক ঐক্য দেখতে পেলাম। বিশেষ করে পুজিঁপতি রাজেন্দ্র যখন অনুপের শ্রমিক সমাবেশে হামলা করে। আমি অনেকটা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলাম আইজেনস্টাইন যেমন অক্টোবর ও ব্যাটলশিপ পটেমকিন ক্রাউড শুটিং করায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তেমন কিছু দেখবো বলে। কিন্তু অতোটা দীর্ঘ ও ব্যাপক আকারে না হলেও চিত্রবিন্যাস ও কাহিনির সামঞ্জ্য কেমন স্বভাবিক মনে হলো।

 

চরিত্রদের মননের গভীরতা ও আবেগের পরিমিতি প্রকাশের জন্য ক্লোজ-আপ শটগুলো ছিলো অনন্য। শ্রেনীবৈষম্য বোঝানোর জন্য অভুক্ত শ্রমিক পরিবার থেকে মালিকশ্রেনীর অতিভোজনের জাম্প-কাট যেন অন্যরকম দ্যোতনা সৃস্টি করলো। 

গোপার দোতলার সিড়িঁ দিয়ে নেমে যাওয়াকে প্রতীকীভাবে যেমন পজিঁপতি দৃস্টিতে পতন বা স্থলন বুঝিয়েছে। তেমনি মেঠো পথে গাড়িতে বসা থেকে উঠে অনুপের সাথে শির উচ্চ করে পথচলাকে এক ধরনের উত্থান বা উদয়কে যেন নিদের্শ করলো। হাই-এ্যঙ্গেল শট কিভাবে সাবজেক্টকে ক্ষৃদ্র দেখায় আর লো-এ্যঙ্গেল শট কিভাবে সাবজেক্টকে বৃহৎ দেখায় তা এই দুটি সিকোয়েন্সে যথার্থ ভাবে লক্ষ করা যায়। সংলাপের সাথে চরিত্রদের স্টেজিং ও স্পেস ব্লকিং কে এই দুটি ক্যামেরা এ্যঙ্গেলের দক্ষ ব্যবহার এক কথায় অনবদ্য। ইতিহাস সৃস্টিকারী হিন্দিতে নির্মিত “দো ভিঘা জমিন”[১৯৫৩] যে ছবিটি ভারতের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার [১৯৫৪] ও প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার [১৯৫৪]  অর্জন করে তার সাথে উদয়ের পথে [১৯৪৪] তুলনামূলক বিচার করলে সমপর্যায় অর্ন্তভুক্ত করতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় না।

শ্রমিক মিটিং শেষে অনুপ ও গোপা যখন জ্যোস্না রাতে বৃক্ষরাশিতে ঘেরা মেঠোপথে জলের ধারে ‍সংঙ্কোচে প্রেমের আবেশে রবীন্দ্রনাথের “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে , উছলে পড়ে আলো।/

রজনীগন্ধা , তোমার গন্ধসুধা ঢালো সঙ্গীতের মাধূর্যে ভরিয়ে তোলে চারপাশ। ঠিক সেই সময়টার আলো আর আধাঁরের সমানুপাতিক প্রবাহের সাথে ধোয়াটে এক অতিজাগতিক চিত্ররুপ তৈরি হয়। ঠিক এই সিকুয়েন্সটা আমার দেখা অন্যতম সিনেমাটিক সৃস্টি বলে মনে হয়। মনে হলো এতোবছর আগে নয় বরং এইতো গতো সপ্তাহে ধারন করা হয়েছে। ধ্রুপদী বা ক্লাসিকের বোধ বুঝি এই হয়। যা কখনো পুরনো হয় না।

                                               “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে , উছলে পড়ে আলো।"

অনুপের আদর্শ ধারন করা প্লেটো বা মার্ক্সের চেতনার জগত ভিন্ন আর কোথায় পাওয়া যায়? তারপরও অনুপের ধীবুদ্ধিস্বভাব বাস্তবজগতে কতোটা ঝুকিঁপূর্ণ তা আমি আমার নিজের জীবনের অভিঞ্জতা থেকে সামন্য জানি বৈকি। আমার পাঠ অভ্যাস ও লেখালেখির সাথে নিজস্ব মূল্যবোধ অনুসারে ব্যাক্তিগত জীবন ও পেশাগত জীবনের ভারসাম্য রাখার জন্য এক চরম নাটকীয় পরিস্থিতির সূস্টি হয়েছিলো।  এতাদিন পর উদয়ের পথে দেখতে দেখেতে আমার সেই ঘটনাকে পুর্ননীরক্ষিা করার অবকাশ পেলাম। ২০২০ সালে মহামারী করোনার মাঝামাঝিতে বুকার পুরস্কারের শর্টলিস্টেড ৬টি উপন্যাসের সবগুলোর উপর সাহিত্য সমালোচনা লিখবো বলে মনস্থির করেছিলাম। প্রথম দিকে সিতসি ড্যানগারেম্বার “দিস মর্নঅ্যাবল বডি” রিভিউ লিখি যা আমেরিকার এরিজোনা স্টেট ইউনির্ভাসিটির “সুপারস্টিশন রিভিউ” সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত। আভনি দোশির “বার্ন্ট সুগার” এক দীর্ঘ রিভিউ লিখি যা সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত ”কিতাব” সাহিত্য প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং ব্রান্ডন টেইলরের ”রিয়েল লাইফ” এর রিভিউ ইন্ডিয়ার “পাঞ্চ” সাহিত্য ও সংস্কুতিভিত্তিক প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাকি তিনটি উপন্যাস মাজা ম্যানজিস্টির “দ্যা শ্যাডো কিং”, দিযানে কুকের “দ্যা নিউ ওয়াল্ডারনেস” ও ডগলাস স্টুয়ার্টের শাগি ব্যাইন” এর রিভিউ লিখার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিবো বলে ঠিক করি।

দুর্ভাগ্যক্রমে, যেদিন ছুটি নিবো ঠিক তার আগেরদিন আম্মাকে নিয়ে সন্ধ্যায় চোখের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাই। পূর্বকোন ঘোষনা ছাড়াই সেদিন রাতে র্কপোরেট মিটিং কল করা হয়। আর আমি ভালো করে জানতাম সবসময়ের মতো এটা একটা অপ্রয়োজনীয় ও হয়রানিমূলক মিটিং। তাছাড়া বিগত কয়েকমাস যাবত মালিক পক্ষ ও প্রশাসনিক বিভিন্ন নিপীড়নমূলক নিয়ম ও আচরনের বিপক্ষে এক ধরনের চাপা প্রতিবাদ করে আসছিলাম। আর মনে মনে প্রতিঞ্জাবদ্ধ চিলাম যে চাকুরীর কারনে আমি আর কখনো আমার লেখালেখির সাথে কম্প্রমাইজ করবো না। লেখালেখির জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতে রাজি আছি। তাই মোখিক ছুটি নেই এবং মিটিংয়ে জয়েন করিনি। ফলশ্রুতিতে একটা অপমান ও অসম্মানজনক কারণদর্শানো চিঠি প্রদান করে। প্রবল উত্তেজনায় আমি চিঠিটা গ্রহন না করে ছিড়েঁ ফেলি এবং বলে আসি  আপনারদের অযৌক্তিক প্রশ্নের কোন যোক্তিক উত্তর আমি দিতে পারবো না। হয় আজ আপনারা আমাকে চাকুরি হতে বরখাস্ত করুন না হয় আমি পদত্যাগ করছি। ঠিক এক ঘন্টা পর কিছু মিথ্যা অভিযোগ ও কারণ দেখিয়ে আমাকে চাকুরী থেকে ইস্তফা দেয়া হয়।

 

আজ আড়াই বছর পর উদয়ের পথে দেখার পর অনুপের লেখালেখি বিষয়ক কর্মকান্ড দেখে আমার নিজের লেখালেখি বিষয়ক ঘটনঅঘটনার স্মৃতি আমায় সজোরে টেনে তুললো। কাকতালীয়ভাবে, অনুপ যেমন তার উপন্যাসের নাম পূর্বাচল রেখেছিলেন, ঠিক তেমনি সেদিন নিপীড়নমূলক চাকুরী থেকে মুক্তির আনন্দ ও প্রশান্তি ও অসত্য কারন উল্লেক করে বরখাস্তপত্রের অপমান ও যাতনার এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে পূর্বাচলের পথে আমার বাড়ি ফিরেছিলাম। কেমন অপূর্ব মিল। পূর্বাচল- যে দিকে সূর্য উঠে। আলো আসে।



বি.দ্র -১: কতো বছর ধরে এক ঘোরে আছি। আমার শৈশবের পুরানো পূর্বাচলের পটভূমিতে শীত-বসন্ত-গ্রীষ্মের দিগন্তহীন মাঠ প্রান্তর ও বর্ষা-শর
-হেমন্তের বিল হাওড় থেকে কিভাবে বৈচিত্রহীন পাথরের পূর্বাচল হয়ে উঠচ্ছে তার এক মহা আখ্যান লিখবো।




 বি.দ্র -২: যখন ভাবি বিমল রায়ের জন্ম ও বেড়ে উঠা এই বাংলাদেশে। পড়াশুনা করেছেন এই আরমানিটোলা ও জগন্নাথ কলেজে। জমিদার হয়েও সামান্তবাদী ও নব্য পুজিবাদীর শোষণের শিকার হয়েছেন। দেশান্তরী হয়েছেন ঢাকা থেকে কলকাতায়। যার প্রভাব ছিলো তার সকল চলচ্চিত্রে। ৪৭শে ভারতভাগে পূবূবাংলার বিচ্ছিন্নতায় তিনি পেশাগত দিক দিয়ে আরো একবার স্থানান্তর হয়েছেন কলতাকা থেকে বম্বে, বাংলা থেকে হিন্দিতে। তবুও তিনি ছিলেন অনন্য। সর্বদা উদীয়মান।


উদয়ের পথে [১৯৪৪]

বিমল রায়

বাংলা, ভারত

 

 

Comments

Popular posts from this blog

Shoeshine [1946] : Vittorio De Sica

বুনোহাঁস : পলাশ মাহমুদ

Andaz [1949] : Mehboob Khan