দৃষ্টি প্রদীপ : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
দৃষ্টিপ্রদীপে কি বিভূতিবাবুর প্রথম চলিত ভাষায় লেখা উপন্যাস। সম্ভবত উত্তম পুরুষের বয়ানে প্রথম উপন্যাস। ঐ সময়টা কি সাংঘাতিক! একই সময়ে কয়েক রীতির ভাষায় লেখার সুভাগ্য পেয়েছেন। পাঠককুলও ছিল খোলা দুয়ারের মতো। সকল কিছুকে সাগরের মতো উদারতায় গ্রহন করেছিলেন।
জিতু ও সীতার ধর্মীয় সংশয়বাদের এক গ্রান্ড উদাহরণ যেন। সর্ন্দিগ্ধচিত্তে ধর্মকে যাচাইবাছাই করা এক সহনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজকে কতো সহজে অবলম্বন করেছেন।
আমি মুখে মুখে বানিয়ে কথা বলতে ভালবাসি। আপন মনে কখনও বাড়ির কর্তার মত কথা বলি, কখনও চাকরের মত কথা বলি। সীতাকে কত শুনিয়েছি, একদিন মাকেও শুনিয়েছিলাম [৪]
ঠিক এই রকম অনুকরণ আমি ছোটবেলা কতো যে করেছি। তার হিসাব নেই। বিশেষ করে ঘুমোতে যাবার সময়। যখন বাতিগুলো নিবে যেতো। ফিসিফস শব্দ যখন কেউ শুনতে পায়নি, তখন।
দৃষ্টিপ্রদীপ পড়তে পড়তে, জিতুর মতো আমারও শ্বেতশুভ্র স্বাদ জাগলো প্রাণে। যাই হিমালয় যাই। যাই রডোডেনড্রন [রোদরঞ্জন] ঝাড়ের আড়ালে তুষারকাতুরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখে আসি।
আজও সে আরম্ভ করলে বাইবেলটা নিতান্ত বাজে, আজগুবী গল্প। খৃস্টান ইউরোপ এই সেদিনও রক্তে সারা দুনিয়া ভাসিয়ে দিলে গ্রেট ওয়ারে। [৬]
জিতেন্দ্র (জিতু) ও ভবেশের এই অংশটুকু পড়ে ধর্মের শুদ্ধাশুদ্ধ নিয়ে রবিবাবুর গোরার বিনয় ও গৌরমোহনের (গোরা) বচসা স্মরণ হলো। আহারে স্বতন্ত্রতা!
দৈনন্দিন অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে, ছোটখাটো ত্যাগ স্বীকারের মধ্যে দিয়ে, পরের জন্যে খাটুনি ও ভাবনার মধ্যে দিয়ে, তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর পারিপার্শ্বিকের মধ্যে দিয়ে এই যে এতগুলি প্রাণীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবনযাত্রার গুরুভার নিজের ওপর নিয়ে সংসার-পথের চলার দুঃখ–এই দুঃখের একটা সার্থকতা আছে। [১৪]
ঠিক এই ভাবনায় অর্ধেক জীবন কতক ফেলে আসলাম। আর কতক বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বুঝলাম এ শুধু বিভূতিভূষণের কল্পনামাত্র নয়। আরো বুঝলাম আর স্বীকার করে নিলাম, এই পৃথিবীতে অনুপম অনন্য বলে কিছু নেই। অবিকল কিছু সমানভাবে কোথাও না কোথাও ঘটে চলচ্ছে। তাই দাম্ভিকতা নয় উদারতাই একমাত্র পাথেয়। একমাত্র আরাধ্য।
📘দৃষ্টি প্রদীপ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রবাসী, ১৩৪০ বাং [১৯৩৩]
Comments
Post a Comment