আরণ‍্যক : বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়


 আরণ‍্যক পড়িতে আসিয়া জাপানি চিত্রকর হকুসাই [Hokusai] সম্পর্কে জানিতে পারিলাম। গুগল সার্চ করিয়া উনার সমুদ্রঢেউ, জলপ্রপাত আর পর্বতশ্রেণীর অঙ্কিত চিত্রাবলী দেখিয়া মুগ্ধ হইলাম। ইহার মধ‍্যে মহাঢেউয়ের ছবিটা এদিক সেদিক দেখিয়াছিলাম। কিনতু জানিতাম না ইহা হকুসাইয়ের।

                চিত্রকর: হকুসাই

রবীন্দ্রনাথ যেমত প্রণয়যুগলের অদলবদল ও পরকীয়া প্রেমের ছকঁ হইতে মুক্ত করিতে পারেন নাই। বিভূতিবাবু তেমত তার মূলচরিত্র শিক্ষিত যুবকের ব‍্যকারত্বের বেড়াজালে ক্রমান্বয়ে পুনরাবৃত্তি করিতেছেন। 

দৃষ্টি প্রদীপ চলিত রূপে লিখিয়া, আরণ‍্যকে সাধুভাষায় প্রত‍্যার্বতণ করিলেন? নাকি দৃষ্টি প্রদীপের পূর্বেই আরণ‍্যক আরম্ভ করিয়াছিলেন।

বাক‍্যোন্তে পূর্ণচ্ছেদের পরিবর্তে হাইফেনের ব‍‍্যবহার- একি সাথে যুক্ত-পদ বা শব্দ-জোড়ায় হাইফেনের  ব‍্যাবহার মাঝে মাঝে সংশয়ে ফেলিয়া দেয়। পড়ার গতিকে করিয়া তোলে ধীর ও ঘন। 

অনেকদিন যাবত আমার মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধমঞ্চের উপর উপন‍্যাস লিখিবার জন‍্য গবেষণাব্রতরত আছি। বিশেষ করিয়া মধ‍্যপ্রাচ‍্যের মরভূমি সম্বন্ধে ভালো ও নির্ভরযোগ‍্য কিছু গ্রন্থের সন্ধান করিয়া চলেছি। আজ আরন‍্যক পরিবার সময় মরু অভিযাত্রিক Sven Anders Hedin এর খোজঁ পাইয়া বড়ই পুলকিত হইলাম। 

বনদাবানলে বনপশুদের প্রাণ বাচাঁবার যে পাগলপ্রায় প্রচেষ্টা তাহার বিবরণ পড়িয়া কিছুক্ষণ বিজনে বিবশ হইয়া  বসিয়া রইলাম। কয়েকদিন আগে এই ক্ষুদপিপাসার চৈত্রসংক্রান্তিতে ঢাকার বঙ্গবাজার অগ্নিকান্ডে মানুষের  অশেষ হাহাকার ও যাতনার কীর্তন, ঠুংরি আর নহবৎ কর্ণকুহরে অনিমেষ বাজিতে লাগিল। মনে হইলো এক বন‍্য নীলগাই পাল আমার বুকে বিছানো দধ্লি ফুলের শতরঞ্জিটা পদাঘাতে দুমড়ে মুচড়ে গেলো।


দৃষ্টি প্রদীপে যেমন জিতুর আশরীরী ও অদেখার জগতের সাথে দেখার জগতের সহাবস্থানের চিত্র আকিয়াছেন। পৌষপার্বন দোলবসন্তেরর মেলা ও জনসমাগমের সাথে রোগপ্রাদুর্ভোগের মহামারীর আলেখ‍্য লিখিয়াছেন। আরণ‍্যকেও তেমনি বিভূতিবাবু আলৌকিকতার ও মহমারীর সুচিত্রায়ন করিয়াছেন।  জিতুর ঘটনার ভবিতব‍্যের ইঙ্গিত বোঝার ক্ষমতা আর জঙ্গল মহালে কুকুরমানবীর দেহরূপান্তর [shapeshifting] এর ঘটনা জাদু-বাস্তবতার প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যকেই কি ইঙ্গিত করে না?


বনপরিবেশ সুরক্ষার জন‍্য আরণ‍্যকে সত‍্যচণের ভাব ও ভাবনার স্রোতে ডুবে ছিলেন। যেভাবে জঙ্গল-মহালকে বাস ও কৃষি উপযোগী করে প্রজাবিলির ব‍্যবস্থা না করিয়া সময়ক্ষেপণ করিয়াছেন। যদি ভুল না হইয়া থাকে, তাহলে আরণ‍্যক বাঙলা ভাষার প্রথম পরিবেশবাদী আখ‍্যান বলিতে পারি। অন‍্যভাষায় কেমনতর তা অবকাশে খুজিতে হইবে। কিংবা কোন দার্শনিক তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কিনা? যদি তাহা না হইয়া থাকে তাহলে বিভূতামশাই এক বিপ্লব বলিতে হইবে।


দক্ষিণ-পূর্বের বিজিত অর্নাযদের ইতিহাস [১১] কি করিয়া উত্তর-পশ্চিম বিজয়ী আর্যদের ইতিহাস দিয়ে রুদ্রপলাশের রঙে চাপা পড়িয়াছে তাহা জানিয়া অবাক হইলাম। এই বিষয়টা এতোদিন আমার একটা নিছক অনুমান ছিল। আজ তাহার সামান‍্য ভিত্তি পাইলো। বর্তমান ক্ষুদ্রতর সাধারন বাস্তবতার সাথে অতীত বৃহত্তম ইতিহাসের এই মিথস্ক্রিয়া বরাবরই আমাকে রক্তকাঞ্চনের সৌরভের মতো আকর্ষণ করে।

রক্তকাঞ্চন

শ্রীবিভূতিবাবু এক অভূতপূর্ব কান্ড করিয়াছেন আরণ‍্যকে। বঙ্কিম বা রবিবাবুর মতো কাব‍্যসংঙ্গীত পদ‍্যাকারে না বলিয়া জয়পাল, রাজু বা বেঙ্কটশ্বেরর কবিতা গল্পের ঢঙে বর্ণনা করিয়াছেন। যা অনকটা সমকালিন গদ‍্যকবিতার পূর্বরাগ বলিতে পারি। বাহ! অপূর্ব!

বিভূতিবাবুই আমার কাছে বাঙলার প্রথম আধুনিক গল্পকার। বোধকরি তিনি  অকৃত্রিমতা ভারে এমন সৃষ্টি করিয়াছেন যাহা স্বমহিমায় ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বদরবারে পদচিহ্ন ফেলিতে সক্ষম হইতেন। বিশ্বসাহিত‍্য সমাজদারেরা দুর্ভাগা যে তার সমময়ে তার কদর করিতে বঞ্চিত হইয়াছেন। নোবেলবঞ্চিত তলস্তয় ও জয়েসের তালিকায় তার নাম নিশ্চয়ই অর্ন্তভুক্ত হইয়া আছে।


আমার নামটি আমি এতোদিন অতো বিশেষ মনে করিতাম না। বরং পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী ছিলাম। কিন্তু মধুর বঙ্কিম-কমল রবি-বিভূতি সবাই যখন পদ্মপলাশ রক্তপলাশ রুদ্রপলাশ শালপলাশের বন পুনঃপুন ব‍্যবহার করিয়া আমার চোখের জলছাপ করিয়া দিয়াছেন। তখন অগ‍্যতা পলাশ নামটি সুহৃদস্বররূপ স্বীকার না করিয়া পারিলাম না।

রুদ্রপলাশ বন

📘আরণ‍্যক

বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় 

১৯৩৮।




আরণ‍্যক পড়িতে আসিয়া জাপানি চিত্রকর হকুসাই [Hokusai] সম্পর্কে জানিতে পারিলাম। গুগল সার্চ করিয়া উনার সমুদ্রঢেউ, জলপ্রপাত আর পর্বতশ্রেণীর অঙ্কিত চিত্রাবলী দেখিয়া মুগ্ধ হইলাম। ইহার মধ‍্যে মহাঢেউয়ের ছবিটা এদিক সেদিক দেখিয়াছিলাম। কিনতু জানিতাম না ইহা হকুসাইয়ের।


রবীন্দ্রনাথ যেমত প্রণয়যুগলের অদলবদল ও পরকীয়া প্রেমের ছকঁ হইতে মুক্ত করিতে পারেন নাই। বিভূতিবাবু তেমত তার মূলচরিত্র শিক্ষিত যুবকের ব‍্যকারত্বের বেড়াজালে ক্রমান্বয়ে পুনরাবৃত্তি করিতেছেন। 


দৃষ্টি প্রদীপ চলিত রূপে লিখিয়া, আরণ‍্যকে সাধুভাষায় প্রত‍্যার্বতণ করিলেন? নাকি দৃষ্টি প্রদীপের পূর্বেই আরণ‍্যক আরম্ভ করিয়াছিলেন।


বাক‍্যোন্তে পূর্ণচ্ছেদের পরিবর্তে হাইফেনের ব‍‍্যবহার- একি সাথে যুক্ত-পদ বা শব্দ-জোড়ায় হাইফেনের  ব‍্যাবহার মাঝে মাঝে সংশয়ে ফেলিয়া দেয়। পড়ার গতিকে করিয়া তোলে ধীর ও ঘন। 


অনেকদিন যাবত আমার মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধমঞ্চের উপর উপন‍্যাস লিখিবার জন‍্য গবেষণাব্রতরত আছি। বিশেষ করিয়া মধ‍্যপ্রাচ‍্যের মরভূমি সম্বন্ধে ভালো ও নির্ভরযোগ‍্য কিছু গ্রন্থের সন্ধান করিয়া চলেছি। আজ আরন‍্যক পরিবার সময় মরু অভিযাত্রিক Sven Anders Hedin এর খোজঁ পাইয়া বড়ই পুলকিত হইলাম। 


বনদাবানলে বনপশুদের প্রাণ বাচাঁবার যে পাগলপ্রায় প্রচেষ্টা তাহার বিবরণ পড়িয়া কিছুক্ষণ বিজনে বিবশ হইয়া  বসিয়া রইলাম। কয়েকদিন আগে এই ক্ষুদপিপাসার চৈত্রসংক্রান্তিতে ঢাকার বঙ্গবাজার অগ্নিকান্ডে মানুষের  অশেষ হাহাকার ও যাতনার কীর্তন, ঠুংরি আর নহবৎ কর্ণকুহরে অনিমেষ বাজিতে লাগিল। মনে হইলো এক বন‍্য নীলগাই পাল আমার বুকে বিছানো দধ্লি ফুলের শতরঞ্জিটা পদাঘাতে দুমড়ে মুচড়ে গেলো।


দৃষ্টি প্রদীপে যেমন জিতুর আশরীরী ও অদেখার জগতের সাথে দেখার জগতের সহাবস্থানের চিত্র আকিয়াছেন। পৌষপার্বন দোলবসন্তেরর মেলা ও জনসমাগমের সাথে রোগপ্রাদুর্ভোগের মহামারীর আলেখ‍্য লিখিয়াছেন। আরণ‍্যকেও তেমনি বিভূতিবাবু আলৌকিকতার ও মহমারীর সুচিত্রায়ন করিয়াছেন।  জিতুর ঘটনার ভবিতব‍্যের ইঙ্গিত বোঝার ক্ষমতা আর জঙ্গল মহালে কুকুরমানবীর দেহরূপান্তর [shapeshifting] এর ঘটনা জাদু-বাস্তবতার প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যকেই কি ইঙ্গিত করে না?


বনপরিবেশ সুরক্ষার জন‍্য আরণ‍্যকে সত‍্যচণের ভাব ও ভাবনার স্রোতে ডুবে ছিলেন। যেভাবে জঙ্গল-মহালকে বাস ও কৃষি উপযোগী করে প্রজাবিলির ব‍্যবস্থা না করিয়া সময়ক্ষেপণ করিয়াছেন। যদি ভুল না হইয়া থাকে, তাহলে আরণ‍্যক বাঙলা ভাষার প্রথম পরিবেশবাদী আখ‍্যান বলিতে পারি। অন‍্যভাষায় কেমনতর তা অবকাশে খুজিতে হইবে। কিংবা কোন দার্শনিক তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কিনা? যদি তাহা না হইয়া থাকে তাহলে বিভূতামশাই এক বিপ্লব বলিতে হইবে।


দক্ষিণ-পূর্বের বিজিত অর্নাযদের ইতিহাস [১১] কি করিয়া উত্তর-পশ্চিম বিজয়ী আর্যদের ইতিহাস দিয়ে রুদ্রপলাশের রঙে চাপা পড়িয়াছে তাহা জানিয়া অবাক হইলাম। এই বিষয়টা এতোদিন আমার একটা নিছক অনুমান ছিল। আজ তাহার সামান‍্য ভিত্তি পাইলো। বর্তমান ক্ষুদ্রতর সাধারন বাস্তবতার সাথে অতীত বৃহত্তম ইতিহাসের এই মিথস্ক্রিয়া বরাবরই আমাকে রক্তকাঞ্চনের সৌরভের মতো আকর্ষণ করে।


শ্রীবিভূতিবাবু এক অভূতপূর্ব কান্ড করিয়াছেন আরণ‍্যকে। বঙ্কিম বা রবিবাবুর মতো কাব‍্যসংঙ্গীত পদ‍্যাকারে না বলিয়া জয়পাল, রাজু বা বেঙ্কটশ্বেরর কবিতা গল্পের ঢঙে বর্ণনা করিয়াছেন। যা অনকটা সমকালিন গদ‍্যকবিতার পূর্বরাগ বলিতে পারি। বাহ! অপূর্ব!


বিভূতিবাবুই আমার কাছে বাঙলার প্রথম আধুনিক উপন‍্যাসিক। বোধকরি তিনি  অকৃত্রিমতা ভারে এমন সৃষ্টি করিয়াছেন যাহা স্বমহিমায় ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বদরবারে পদচিহ্ন ফেলিতে সক্ষম হইতেন। বিশ্বসাহিত‍্য সমাজদারেরা দুর্ভাগা যে তার সমময়ে তার কদর করিতে বঞ্চিত হইয়াছেন। নোবেলবঞ্চিত তলস্তয় ও জয়েসের তালিকায় তার নাম নিশ্চয়ই অর্ন্তভুক্ত হইয়া আছে।


আমার নামটি আমি এতোদিন অতো বিশেষ মনে করিতাম না। বরং পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী ছিলাম। কিন্তু মধুর বঙ্কিম-কমল রবি-বিভূতি সবাই যখন পদ্মপলাশ রক্তপলাশ রুদ্রপলাশ শালপলাশের বন পুনঃপুন ব‍্যবহার করিয়া আমার চোখের জলছাপ করিয়া দিয়াছেন। তখন অগ‍্যতা পলাশ নামটি সুহৃদস্বররূপ স্বীকার না করিয়া পারিলাম না।


📘আরণ‍্যক

বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় 

১৯৩৮।

Comments

Popular posts from this blog

The Circus : Charlie Chaplin

শুদ্ধ দেশ: পলাশ মাহমুদ

As breezes flowing low : Palash Mahmud