অপরাজিত : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
অপরাজিত সম্ভবত প্রথম উপন্যাস। বর্ষার বারিধারার মতো অনর্গল পড়িয়া যাচ্ছি। গল্পের কী শুক্ত গাধুঁনি। ভাষার কী সহজ প্রবাহ। নিমিষেই পাতা শেষ হইয়া যাচ্ছে। পাঠক মাত্রই নিজেকে এর ছাঁচে নিজেকে যুতসই বসাইতে পারে।
শুরু থেকে অপরাজিত এক আশা ও সংগ্রামের গল্পধারা। মাঝে মাঝে আপনজজনকে ছেড়ে দেশান্তরি হওয়া। পরজনকে ধরে নবজীবন যাপন করা। নিশ্চিন্দিপুর ইছামতী দূর্গা হরিহর সর্বজয়া রীণাদি লীলা দেবব্রত অনিল নির্মলা অপর্ণা কাজল (অমিতাভ) মনে করে করে দিনের শূণ্য প্রহরগুলো পূর্ণ করা আদ্র হওয়ার আখ্যান। শুষ্কবক্ষে কি করিয়া প্রাণ দিতে হয় অপরাজিত তাহারই কাহিনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উপর কাজী নজরুল ব্যতীত আর কোন কোন সমসাময়িক লেখক গল্পের এর রেফারেন্স আনিয়াছেন। অনেকদিন যাবত খুজেতেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ সামান্য আনিয়াছেন। অপরাজিতে বিভূতি যুদ্ধের কারনে দ্রবমূল্য বৃদ্ধির [৬] প্রত্যক্ষ প্রভাব এনেছেন ঠিক এখন যেমন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা দ্রবমূল্যকে আকাশচুম্বী করিয়া তুলিয়াছেন।
অপু আর অনিলের জাহাজের খালাশীর চাকুরী পাওয়ার জন্য একরোখা অনুনয় বিনয় তা চমকপ্রদ। অমিতাভ ঘোষ তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে, সম্ভবত কোন এ্যামবাসিত ঠিক এমন একটা কাজ পাবার প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন।
দুর্গা নয় অনিলের মৃত্যু[৯] যেন আমার মনের মাঝে স্ট্র্যাঙ্গুলেটেড হার্নিয়ার মতো মোচড় দিলো। নিমিষেই চোখ জলে ভরে উঠলো। আহা রে অপু! আর কতো দহন দাহিবে তোমায়?
মানুষ মানুষের বুকের কথা জানিতে চায়। আজ যা তুচ্ছ, হাজার বছর পরে তা মহা-সম্পদ। ভবিষ্যতের সত্যকার ইতিহাস হইবে এই কাহিনী, মানুষের মনের ইতিহাস, তার প্রাণের ইতিহাস।[১০]
জীবনের ইতিহাস নিয়ে এমন ভাবিয়া আসছিলাম, সে কতোকাল।
মানুষ মরিয়া কোথায় যায়? ভিজা জুতাকে রৌদ্রে দিলে তাহার উপরকার ছাতা কোথায় যায়?[১৫]
এই মহাবিশ্ব -যা আমদের ভাবনার ভেতরে ও কল্পনার বাইরে অস্তিত্বমান। তার সাথে এই পোকার মতো ক্ষুদ্র জগত ও ধূলিসম মানবজীবনে সাদৃশ্যানুমাণ নিয়ে বিভূতি কিংবা রবীন্দ্রনাথ ও এমন দার্শনিক প্রশ্ন করেন নাই। আমি অভিভূত!
আর কোনও জালে নিজেকে জড়াইবে না—সব দিক হইতে সতর্ক থাকিবে-শিকলের বাঁধন অনেক সময় অলক্ষিতে জড়ায় কিনা পায়ে![১৬]
পুরাতন দিল্লি বাল্যের সে ইটের পাঁজাটা নয়। কুতবমিনার নতুন দিল্লি শহর হইতে যে এতদূর তাহা সে ভাবে নাই। [১৭]
১৯১০ দশকর কলকাতা দিল্লি শহর সম্পর্কে এ অংশটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
যুগে যুগে অপরাজিত জীবন-রহস্য কি অপূর্ব মহিমাতেই আবার আত্মপ্রকাশ করে।[২৬]
এই যে এক জগতের আড়ালে হাজার জগতের হাতছানি। এই যে এক জীবন ফিরিয়া আসে হাজার জীবন হয়ে। এই যে অপরাজিত জীবন ও জগতের ক্ষদ্রতার মাঝে বৃহত্তরের প্রকাশ; সীমার পাশে আসীমের ডাক। এই বোধ আমাকে অমিত আভায় বিবশ করে রাখে। আমি ভাবি জগতের সকল অবভাসে নিজের স্বরূপকে বোঝা। কতো যে মূল্য! কি যে পাথেয়! কেমন যে আলোর সারথি! তাহা সকলে যদি বুঝিতো?
📘অপরাজিত
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৩২।
Comments
Post a Comment