পথের পাঁচালী : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বঙ্কিম পাঠান্তে যখন রবীন্দ্র পঠন আরম্ভ করিয়াছিলুম, তখন ভাষার শৈলীতে এক মূলোৎপাটনকারক পরিবর্তনের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিলো। কিন্তু আখ্যানবস্তু ততোধিক বদল বা নবনত্বের অভাবে তাড়িত হইতেছিল।
মধুসূদন যেমন করিয়া পদ্যচরণে বিচিত্ররূপে যতির ব্যবহার করিয়াছেন- তেমনি বিভূতিবাবু গদ্যবাক্যে চ্ছেদ চিহ্নের ব্যবহারে আনিয়াছেন অনন্যতা। বিশেষ করিয়া পৃর্ণচ্ছেদের পরিবর্তে হাইফেন বা ড্যাশ চিহ্নের ব্যবহার বাঙলায় পূর্বে এমন করিয়া আর কেহ করিয়াছেন কিনা জানা নাই।
রবীন্দ্র গোরা পাঠের অবসরে যখন বিভূতির পথের পাঁচালী ছায়াবীথিতলে চলিতে শুরু করিলাম। তখন এক অবিশ্বাস্য অপ্রতিমতার সহিত যেন মিলিলাম। রাবীন্দ্রীয় ভাষার ছাঁচকে বৃহত্তর বাঙলার বনজলমাটির আতুরঘরে সামঞ্জস্য করিয়া তুলিল। আর বিষয়বস্তু নিজেই যেন এক নবযুগে আসিয়া পদার্পণ করিল। ইছামতির জলে নিজের অবয়ব দেখিয়া চমকিয়া উঠিল।
অপু মায়ের কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের বাঁধ না মানিয়া ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল–দিদির জন্য বড্ড মন কেমন করছে!..[১০]
এই যে সহোদরের জন্য বাঁধভাঙ্গা দরদ। এই বাক্যখানি পড়িবার মাত্রই, কোথা হইতে যেন, জৈষ্ঠ্যের কৃষ্ণতিথিতে দিক্ষিণের উষ্ণ হাওয়ার সাথে পাতা উড়ানোর যে র্মর্মর শীষধ্বনি বাজিয়া উঠে। তেমন করিয়া আমার মনের অতলে এক বাতাস বহিয়া গেলো।
সঙ্গে সঙ্গে বাগানের মাথায় বৃষ্টির ধোঁয়ার রাশি চিড়িয়া ফাড়িয়া উড়াইয়া, ভৈরবী প্রকৃতিব উন্মত্ততার মাঝখানে ধরা পড়া দুই অসহায় বালক-বালিকার চোখ ঝলসাইয়া তীক্ষ্ণ নীল বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। [১৩]
এ বিজলীবৃষ্টির ধুমাধুর তান্ডবের মাঝে আমি যেন কতো শৈশবস্মৃতি আবরণে আচ্ছাদিত হয়ে পড়লাম। এ শৈশবদৃশ্য এক চিরায়ত গ্রামীণ অলংকার।
বৈদিকসাহিত্য, আরব্যসাহিত্য ও পল্লীসাহিত্যর প্রসঙ্গ কি অপরূপে কৌশলে অর্ন্তভুক্ত করিয়াছেন-তাহা এক কথায় অপূর্ব।
গ্রামের যাত্রাদল ও বয়োস্কপের দৃশ্যাবলী আমার প্রজন্ম পর্যন্তই পাইয়াছিলাম। তারপর সবকিছু মেঘেঢাকা তারার মতো কোথায় হারিয়ে গিয়াছে - ঠিক করিয়া বলিতে পারিনা। বর্ষার জলবৃষ্টির তোড়ে কৈ মাছ যে পুকুরপাড়, খালের ধার, পথের উপর ও ঘরের দুয়ারে লাফাইয়া উঠে- সেই শৈশবস্মৃতি মনে করিয়া -মনটা কেমন করিয়া ভার হইয়া উঠিল।
"-চিরকালটা ওর সমান গেলো..." থেকে "... দুর্গা আর চাহিল না।" [২৫]
এই অংশটুকু আমার জীবনে কলোরবের সাথে এমন করিয়া এল মেলবন্ধন অটুট করিয়া চোখের সামনে ভাসাইয়া তুলিবে - পাঠপূর্বক ভাবিয়া উঠিতে পারি নাই।
পুরাতন বঙ্গবাসী পাঠ [২৭]ও গ্রন্থপাঠের বিনিময়ে মাছ চৌক [২৭]দিবার ঘটনা বড় মনোরম লাগিল- আমার কৈশোরে বিদ্যালয় গমনের পথে রাস্তায় কুড়িয়ে আনা সংবাদপত্র বা প্রতিবেশির বাটী হইতে চেয়ে চিন্তে খবরের কাগজ পাঠ করা- শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী ও সাপ্তাহিক পড়িবার লোভে অধৈর্য হয়ে- বাটীতে কাউকে না জানিয়ে কয়েক মাইল পায়ে হেটে খিলক্ষেত বাস্ট্যান্ডে দিকে রওনা দেয়া কিংবা বাজাররে মনোলোভা বুকশপে, বই কিনিবার ছলে কয়েক পাতা পড়িয়া আসার স্মৃতি মানসপটে বানের জলের মতো তেড়ে আসিল। কী আশ্চর্য মিল প্রায়!
অপূর্বকুমার যেমত করিয়া রাণুদি, অতসীদি ও অমলাদি হইতে লীলার সৌন্দর্যে অধিক মৌহিত হইয়াছিল - আমি সমরূপে বঙ্কিমদা, মধুদা ও রবিদা হইতে অধিক বিভূতি বাবুর সাহিত্য ঐশ্বর্যে বিমোহিত হইয়া পড়িলাম।
সত্যি বলতে কি - রবিবাবুর উপন্যাস পাঠান্তে বিভূতি পাঠারাম্ভ করা- সমগ্র সাহিত্যপাঠে সর্বাধিক শুভযোগ কিংবা যথার্থ সিধান্ত বলিয়া বোধ হইলো।
আজ অবদি যতো বাঙলা আখ্যান পড়িয়াছি - তারমধ্যে পথের পাঁচালী যেন পরিপূর্ণ উপন্যাস বলিয়া মনে হইলো। কিছু কিছু উত্তম বিভাষী সাহিত্য হইতে উত্তমতর লাগিল।
পাকা বটফলের গন্ধেভরা বাতাসটার [৩৫] মতো আমার মনটা যেন আজ বিশবছর আগের বিদ্যালয়ের পশ্চিমকোণের প্রকান্ড বটবৃক্ষের শতশাখাপ্রশাখা হইতে নেমে আসা বটমূলে ঝুলিয়া রইলো কিছুক্ষণ। পথের পাঁচালীর মতো আর কোথাও কেন আমি নিজেকে খুঁজিয়া পাইলাম না।
📘পথের পাঁচালী
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯২৯।
Comments
Post a Comment