বিপিনের সংসার : বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

 


দৃষ্টি প্রদীপের পরের উপন‍্যাস গুলোতে কাহিনী আর বর্ণনাভঙ্গি এমন করি বদলে গেলো ভেবে অবাক হই। এর প্রভাব অনেকটা সাধু থেকে চলিততরীতিতে অনুসৃত হওয়ার প্রভাবের মতোই বোধ হলো।

বিপিননের সাথে মানীর যে রাগ অনুরাগের পালা চলচ্ছে তা অনেকটা দুইবাড়ির মঞ্জুরী নিধিরামের অপ্রকাশ‍্য অলক্ষ প্রণয়ের ধারাকেই মনে করিইয়ে দিলো। মানীর পোলাওকান্ড ও বিপিনের ছুটিককান্ডখানি বহুত মধুরম লাগলো। রবীবাবু পরককীয়া সম্পর্ক গুলো কেমন গ্রস লাগতো। কিন্তু বিভূতির পরকীয়া ধারাতে কেমন একটা রোমান্স ও অ‍্যাডভ‍্যাঞ্জারে ভরা। যেন বসন্তের লাবণ‍্যপ্রভায় দীপ্ত।

বিপিন বিশ্বেশ্বর আর জয়কৃষ্ণর দীন হীন যাপিত জীবন আশা ও নৈরাশ‍্যর আলাপনের মাঝে বিপিন যে নিজকে ধনী ভাবলো তা চমকপ্রদ। জগতে দুঃখ ক্লেশ যে আপেক্ষিক এই ধ্বনি যে বেজে উঠলো। কাহিনির এই অংশটুকু এক গভীর প‍্যারাবল বলে মনে হলো।

বিপিন আর বলাইয়ের ভাতৃত্বের পারস্পরিক নির্ভরতা খুব মনে ধরলো। শশ্মান ঘাটে বড়শিতে মাছ ধরতে গিয়ে কচ্ছপকান্ড কেমন প্রতীকি হয়ে উঠলো। খানিক সময়ের জন‍্য অপুদুর্গার স্মৃতিকাতরতায় মনটা ভার হয়ে গেলো।

মানী যে বিপিনকে পুনরায় পড়াশুনায় উদ্বুদ্ধ করে তুললো তা যেন এক বিস্ময় জাগনিয়া। প্রসঙ্গক্রমে শরৎচন্দ্রের দত্তার সাথে ভুবনমোহিনীর তুলনায়  ভালো উপন‍্যাসের যে মন্তব‍্য করলেন তাও চমকপ্রদ। বিভূতিবাবু প্রায়শই অগ্রজ সাহিত‍্যিকদের কর্মকে নিজ কর্মে প্রাসঙ্গিক উল্লেখ করা। রবীন্দ্র যেমন বঙ্কিমমধুকে করেছেন, নজরুল যেমন রবীন্দ্রকে এনেছেন তেমনি বিভূতিবাবু তার সমসাময়িক অনেকই নিয়ে এসেছেন। বর্তমান লেখদের এমন করতে দেখা  যায় কি পড়ে দেখতে হবে। অবশ‍্য এটা আবশ্যক নিয়ম হিসাবে পালনীয় বলে মনে করি না। তবে লেখায় কেমন একটা ভালোলাগার শিহরণ লাগে।

মনোরমা ও মানীর দেহ ও মন সম্বন্ধে বিপিনের ফ্রডেয়ী ভাবনাগুলো এতো সচ্ছ ও বাস্তবঘেষা। ঠিক এই ব‍্যাপারটা মানে মানষের মনোগ‍্যামী ও বহুগামীতার প্রবনতাটা নিয়ে আমি কিছুদিন আনমনে ভেবেছিলাম।

বিপিনের খেজুরের ভাড়ে মূল‍্যস্বরূপ দুআনা রেখে যে রসের নৈতিকতা দেখালো, এমনতর নৈতিকতার ভারে আমার নিজের জীবনাচরণই  কন্টার্কীন আবার মাঝে মাঝে পুষ্পায়িত হয়ে আছে দিবারাত্রি।

কামিনী বিনোদের গোপন প্রণয়ের সাথে বিপিন মানীর অব‍্যক্ত প্রেমের সাদৃশ্যানুমান কি অনুপম ধারায় বর্ণনা করলো। কেমন ঘোরের আবেশ লাগলো মনে।

"জমিদারী শাসন ছাড়াও পুরুষমানুষের জীবন আছে- রোগের সঙ্গে, ভৃত‍্যু সঙ্গে নিজের দারিদ্র্যের সহিত সংগ্রাম করিয়া বড় হইতে চেষ্টা পাওয়াও পুরুষমানুষের কাজ। একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব।

আদর্শ ম‍্যাসকুলিনিটির এমন বিরুদ্ধ মত বাঙলা তেমন লেখা হয় না। পরিচয় ও সামাজিকতার এমন সংশ্লেষাত্মক বিচার চমকপ্রদ।

বিপিন বোধ হয় বিভূতিবাবুর সবচেয়ে রক্তমাংশের মানুষ। যার যাপিত জীবন বাস্তবতার পাথরে বাধাই করা। এই যে সংসারের জন‍্য তার ডাক্তারীর ছ্দ্মপেশা অবলম্বন। আবার ব‍্যাক্তি হিসাবে তার উদারতা ও পেশার নৈতিকতার চর্চায় শক্ত অবস্থানে আমি মুগ্ধ। বারবার নতুন নারীর মায়া ও করুনায় জড়িয়ে আবার বিমুক্ত থাকার প্রানন্তর প্রয়াস আমাকে চমকে দেয় বাবার। মনের মুক্তি না মিলিলে জীবন যে তার অর্থ খুজেঁ পায় না। বিপিনের এই অসামান্য অনুভবটুকু আমার এক রাশ ভাবনার দ্বার খুলে দিলো।


📘বিপিনের সংসার

বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

১৯৪১।

Comments

Popular posts from this blog

The Circus : Charlie Chaplin

শুদ্ধ দেশ: পলাশ মাহমুদ

As breezes flowing low : Palash Mahmud