দুই বাড়ি : বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

 



দুইবাড়িতে আসিয়া বিভূতিমশাই আবারও প্রথমে সাধুভাষায় লিখিতে শুরু করিয়াছেন। কিয়দাংশ পরে আবার চলিতরূপে ফিরিয়া আসিলেন। এমন মিশ্রণ কি উনি পরীক্ষামূলকভাবে করলেন? নাকি ঐ সময় বাস্তবতায় ভাষার এমন দোলাচালকেই পরিস্ফুটিত করলেন? বোঝা গেল না।

দুই বাড়ি নামটি আমার কাছে কেমন ক্রমে ক্রমে প্রতীকী হইয়া উঠিল। দুই বাঙলা নামটি কেমন কানে কানে বাজিতে লাগলো। 

একটা বিষয় এখনো আমার খটকা লাগে। দেশভাগপূর্বে সকল বাঙলার লেখকে পূর্ব পশ্চিমে ভাগ না করে শুধু বাঙলার লেখক বলে পরিচয় দিলো দোষটা কোথায়। বিশেষ করে যখন বঙ্কিম মধুসূদন রবীন্দ্র বিভূতির বেশিরভাগ উপন‍্যাসের প্রেক্ষাপটে ঢাকা রাজশাহী কুমিল্লা ময়মনসিংহ ফরিদপুর যশোর খুলনা দিনাজপুর ও অন‍্যান‍্য স্থানগুলোতে ছিল। মনে হয় না তারা সেই সময় নিজেদের সত্তাকে এমন করে নানান দিক ও সীমান্তে খন্ড খন্ড করিয়াছিলেন। তবে একটা জায়গায় তারা আলবদ তারা বিভক্ত ও বৈষম্য আর্কীণ ছিলেন।  বৌদ্ধ মুসলিম ও ক্রিশ্চিয়ান মতো বহুর্ধম ও জাতি যেরূপ বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ‍্য অংশ হয়ে ছিল তার যর্থার্থ প্রতিফলন তাদের লেখায় উঠে আসে নাই। এইখানে তারা মহৎ সৃজনশীলতার চরম অপচয় করেছেন। ছিলেন সাহিত‍্যিক সংশয়সাগরে পূর্ণ নিম্মজিত। আমার মনে হয় বর্তমান রীতিতে দেশের ধারনার আগে ভাষার ও সংস্কৃতির ধারনা এসেছে। এমনকি দেশের নামটি হয়েছে ভাষার ভিত্তিতে দাড়িয়ে। ভাষা ও সংস্কৃতি প্রথম ও প্রধান ভিত্তি। বাকি বিশ্বাস ও ব‍্যাবস্থা দূর কি বাত, কালে কালে তার অদল বদল হয়।

মঞ্জুর গান শুনতে শুনতে নিধুর মায়ের সজল চোখে স্মৃতিকারতা কেমন উদাস করে দিলো মনটা। কি গান গেয়েছিলো জানার জন‍্য মনটা ব‍্যাকুল হয়ে উঠেছে।

নিধিরাম মোক্তারের ব‍্যবহৃত শব্দভান্ডারগুলো সামন‍্য খেয়াল করে দেখলাম। আবার বর্তমান আইনি ভাষার সাথে তুলনা করে বুঝলাম। ভারতীয় লিগ‍্যাল পরিভাষাগুলো প্রাথমিকভাবে আরবি ফারসি এবং ক্রমে ইংরেজি ভাষার দিকে সরে এসেছে। তৎসম বা তদ্ভব শব্দগুলো পৌরাণিক ও রাজ‍্যযুগে যতোটা প্রভাবক ছিল। মুসলিম (র্ধমতাড়িত) বা ব্রিটিশ (রাষ্টক্ষমতা) উপনিবেশ যেন ধর্ম ও  রাষ্টকে ছাপিয়ে ভাষাতেই তাদের সর্বোচ্চ শক্তির প্রকাশ পেয়েছে। সবকিছুই হালকা হয়ে গেলোও ভাষার আধিপত্যকে এড়াতে পারেনি।

সাধন মোক্তারের আসামী পড়ানো ও মিথ‍্যা জবানবন্দি সাজনোর গল্পাংশটি খুবই বাস্তবঘেষা। এমন ঘটনা যে চিরন্তন তা আজও পাড়ায় পত্রে সাক্ষাৎ পাই।

দুইবাড়ি এখন পর্যন্ত আমার পড়া অন‍্যতম সেরা পেশাভিত্তিক উপন‍্যাস। শেষবার শংকরের চৌরঙ্গির এক তৃতীয়াংশ  পড়েছিলাম। যেটা আবাসিক হোটেল পেশাজীবন নিয়ে লেখা। একইসাথে আসমী ও ফরিয়াদীর মামলা ও এজহার নিয়ে প্রথম পক্ষের নিকট সামান‍্য মুখের কথার জন‍্য দ্বিতীয় পক্ষের নগদ টাকার প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিলেন। এই বিষয়ে তার মহুরীর সাথে যে নৈতিক বচসা হয়। তা এক কথায় বিস্ময়কর। ঠিক এমনই নৈতিক দ্বন্দ্বে আমি আমার পেশার ক্ষেত্রে প্রায়ই মুখোমুখি হই।

মোক্তার নিধিরামের গোপন প্রণয়ের সাথে হাকিম সুনীলের অ‍্যারেঞ্জ বিবাহের দৃশ‍্যটা পুরো উপাখ‍্যানকে ক্লাইমেক্সের চৌরঙ্গিতে দাড় করিয়ে দিলো। 

চৈত্রের শেষে যেমন কেমন এক উষ্ণ শীতল বায়ু অগ্নিকোণে খেলে যায়। তেমন যেন এক তপ্ত হাওয়া মঞ্জুরীদের বন্ধদোরে এসে থমকে গেল। 

📘দুই বাড়ি

বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

 ১৯৪১।


Comments

Popular posts from this blog

The Circus : Charlie Chaplin

শুদ্ধ দেশ: পলাশ মাহমুদ

As breezes flowing low : Palash Mahmud