অশনি সংকেত : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পৃথিবীতে এমন লোকও আছে যাদের ভালোও বলা যায় না আবার খারাপও বলা যায় না। গঙ্গাচরণ কি এই স্তরে বাস করবেন উপন্যাসের বাকিটা কাল। এই প্রথম বোধহয় বিভূতিবাবু তার মূখ্য চরিত্রদের করেছেন ঈষৎ স্বার্থবাদী। ঈষৎ উদার। অবাক হলাম।
কিন্তু একটা ছক থেকে বিভূতি নিজকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারলেন কি। সবর্ত্র মূখ্য চরিত্ররা হয় দেশান্তরি নয়তো মুসাফির। গঙ্গাচরণ বোধ করি পূর্বের সকলেক কয়েক ধাপ ছাড়িয়ে গেলো।
মহামারী ঠেকাতে মন্ত্র পড়ে গাঁ বন্ধ করা সম্পর্কে অনঙ্গ বউয়ের স্বাস্থ্য প্রবেশিকার বিধিনিষেধ এর উপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে যখন মন্ত্রপাঠকে নাকচ করে দিলেন। একজন ব্রাহ্মণ হয়ে এমন কথা বলা এক দুসাহসিক কাজ বৈকি। আজ ২০২৩ এসে কেউ এমন কথা বললে নিমেষেই পাঠানকান্ড ঘটে যাবে।
কিন্তু একটা ব্যাপার খুব লাগলো মনে। মহামারী নিরোদ করার জন্য গঙ্গাচরণ একদিকে যেমন গাঁ বন্ধ (লক ডাউন) করতে ভক্তিভরে সিদঁর-তেল মেখে গাবকাঠের পুতুল মাটিতে পুতঁলেন, ঈশানকোণে (উত্তরপশ্চিম কোণ) নিমগাছে ধব্জা বাধঁলেন, শান্তিজল ছিটালেন। তেমনি স্বাস্থ্য সচেতনতাস্বরূপ গ্রামবাসীকে নদীর জলের বদলে ডাবের জল, খোলা বা বাসি পচা খাবার থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিলেন। কী ম্যানুপুলেটিভ!
যুদ্ধের করালে সমগ্র বাঙলার খাদ্যশস্য যেন হাওয়ায় মিশে গেলো। সাথে যুক্ত হলো শাসক, ধনীক শেণী ও ব্যবসায়ীদের লোভাতুর নখরামী। কলেরা মহামারী ও প্রকৃতি বিরূপে পদ্মবিলের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছ সকল বৃক্ষজলভূমি।
চালের দাম হু হু করে বাড়ছে...
ঐ আসছে দূরের ভিক্ষু,
একা একা,
দলে দলে...
হায়! এ যেন এই আজকের দহনের দিন,
গ্রহণের রাত।
কোথায় পাবে মুক্তির হাওয়া,
কোথায় পাবে শান্তির জল?
অবশেষে বাঙলায় তেতাল্লিশের মহাযুদ্ধজনিত দুর্ভিক্ষের উপর একটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস পেলাম। তাও একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে। সেও আবার বিভূতিভূষণ! অনেকদিনযাবত এর সন্ধানে ছিলাম। মেসোপটেমিয়ায় বাঙ্গালী তথা ভারতীয় পল্টনের উপর আখ্যান লিখার পর ২য় বিশ্বযুদ্ধে বাঙলার দুর্ভিক্ষের উপর গল্প বা উপন্যাসিকা নয় বরং এক মহা উপন্যাস লেখার সুতীব্র আকাক্ষা, সেই কবে থেকে মনে মনে লালন করে আসছি। গবেষণার অনেক রসদের মধ্যে এই "অশনি সংকেত" যেন এক অমৃল্য রত্নরূপে যোগ হলো। সহস্রাধিক প্রণাম রইলো শ্রীবিভূতি! বৈকুন্ঠের পদ্মপদে ভালো থাকুন।
জাপান-জার্মানি যে সিঙ্গাপুর দখল করেছে তা নিয়ে গাঁয়ের লোক যখন এর ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করছে, তখন সিঙ্গাপুর নামের মূলে [শিঙ্গা ও পুর] যে আর্য ভাষার ঘনিষ্ঠতা আছে তা লক্ষ করলাম। বার্মা বা মিয়ানমার কে যে ব্রহ্মদেশ কেন বলা হতো তা একটু গবাক্ষে বসিয়া সন্ধান করে দেখবো।
গঙ্গাচরণ ও অনঙ্গ বউ যে একরম কুটিল নয় তার ভুল তবে ভাঙ্গলো এই বেলায়। গঙ্গা পথে দীনু ভটচাযকে নিজের অনেকটা চাল দিয়ে দিলে অনঙ্গ যখন বলে দীনকে দিলে কমে না, বাড়ে। কিংবা দুর্গা পন্ডিতকে অনঙ্গ যখন নিজের অংশের খাবার দিয়ে দিল, এই আকালে, এই অনিশ্চিতে এমন উদারতা, এমন সমবেদনা, কজন মানুষ পাড়ে। প্রণাম লও গঙ্গাচরণ। প্রণাম লও অনঙ্গ। তাদের নামদুটো যেন কেমন প্রতীকী। পুরুষের নাম গঙ্গা! নারীর নাম অনঙ্গ!
কাপালী বৌয়ের ক্ষুধানিবারণে পরপুরুষের সাথে ইটখোলায় ক্রম অভিসার আর শেষ দৃশ্যে দেশান্তরী না হওয়া যেন এক মর্মস্পর্শী আখ্যান। এইখান হতে শুরু হতে পারে আরো এক ক্ষুধার আখ্যান।
মতি মুচিনীর ক্ষুধার হাহাককার আর মৃত্যুদৃশ্যখানি বাঙলা সাহিত্যের মৃত্যুদৃশাবলীর মধ্যে অন্যতম। পথের পাঁচালীর দূর্গার মৃত্যুদৃশ্য থেকেও হৃদয়স্পর্শী।
অনঙ্গবৌ মনে হয় বিভূতিবাবুর অন্যতম নারীচরিত্র। এতোটা নির্মল ও মানবতাবাদী নারীচরিত্র এখনো পড়া হয়নি। সত্যজিতের চলচ্চিত্রায়ন সময় করে দেখতে হবে।
"ফ্যান খাইতাম- ফ্যান খাইতাম", এমন আর্তি পড়ার পর অনেক ক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। আজ সকালটা কেমন নিঃস্ব নিঃস্ব মনে হলো।
পশ্চিমবঙ্গর দুর্ভিক্ষজীবন নিয়ে অশনি সংকেতই প্রথম পড়া। পূর্ববঙ্গ জীবন নিয়ে তেমন কিছু এখনো পড়া হয়নি। পরবর্তীতে হয়তো পড়বো। কিন্তু অখন্ড বাঙলায় মন্বন্তরের অখন্ড চিত্র তুলে ধরতে পেরেছে, এমন কোন মহাআখ্যান লিখা হয়েছে কি। আগুনপাখিতে অল্পবিস্তর রয়েছে। তবে ব্রিটিশাসন, মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বহুজাতিক চরিত্রের মিলিতরূপে একটি বৃহৎ উপন্যাস লিখবো তারই আয়োজন চলছে।
📘অশনি সংকেত
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৫৯ (অসমাপ্ত)
Comments
Post a Comment