আদর্শ হিন্দু হোটেল : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
চূর্ণী নদীর ধারে খোলা হাওয়ায় বসে হাজারি হিন্দু হোটেলের যে আয়েশী পরিকল্পনা করছিলো, ঠিক এই কাহিনি কাঠামোটা ইদানিং কয়েকটা ওয়েব সিরিজে দেখলাম। এমন কি চোখের সামনে কতো জনকে খাবার দোকানের এই রকম আয়োজন করতে দেখলাম। অথচ বিভূতিবাবু শতবছর আগেই কেমন লিখেছেন। সাহিত্যের এই একটা বড় গুণ। লেখক শতবছর পূর্বে যা কল্পনা করেছিলেন, আজ তা বাস্তব হয়ে উঠছে। লেখক মাত্রই বাস্তবতার নিপুণ সৃষ্টিকর্তা।।
আপনার ছিচরণের আশিব্বাদে এক রকম চলে যাচ্ছে। রাণাঘাটেই কাজ কচ্চেন তো? [৩]
পূর্বে বঙ্কিম মধু রবিতে অনাড়ম্বর কথ্য ভাষায় অল্পবিস্তর ব্যবহার করা হয়েচ্চিল। কিন্তু বিভূতি এই লেখার রীতি ও প্রকাশের কৌশল যেন ষোল আনায় দখল করিচ্ছেন। এইখানেও বিভূতি অনন্য ও অপূর্ব স্বাক্ষর রেখেচ্ছেন। পরবর্তীতে ইলিয়াস জহির আজিজুল ঠিক এই ঢঙে যে লিখেচ্ছিলেন তা কে এক্কেবারে অনুপম না বলিয়া পূর্বসূরিদের বিকাশের একটি সামান্য পর্যায় বলা যেতে পারে। অথচ প্রথম যখন ইলিয়াসের খোয়াবনাম পড়েচ্ছিলাম তখন এ দিকটার নতুনত্বে অভিভূত হয়েছিলাম।
বঙ্কিম রবীন্দ্র উপন্যাস রচনায় তাহাদে নির্দিষ্ট বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসেন নি। কিন্তু বিভূতি চাঁদের পাহাড় ও আর্দশ হিন্দু হোটেলে আখ্যানবস্তু ও ভাষাশৈলী উভয় ক্ষেত্রে নব নব স্বাদ নিয়ে এসেছেন।
তবে একটা জায়গায় বিভূতিমশাই নিজেকে কেমন গুমোট করে বদ্ধ করে রেখেছেন। তার মূখ্য চরিত্র সদা সবর্ত্র যেন এক মুসাফিরের, এক দেশান্তরী, এক ঠিকানাহীন পত্র। এ যেন অখন্ডনীয় সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য জীবনের।
"দেখ হাজারি, তোমার কথা শুনে তোমার ওপর আমার হিংসে হয়। তোমার বয়েস হোলে কি হবে, তোমার জীবনে মস্ত বড় আশা রয়েছে একটা কিছু গড়ে তুলবো। এই আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, [৬, হরিচরণ]
আশা আর আত্মবিশ্বাসের উপর মনের ভার রেখেই তো সারা আসমানটা নিজের অধিকার করেচ্চি।
স্টেশনে খদ্দের নিয়ে বেচুর লোকের সাথে হাজারির লোকের যে সম্মুখ সংঘর্ষ হলো। তা আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার গেরিলা মার্কেটিংয়ের সাথে সাদৃশ্যস্বরূপ। আমি ভাবি আর অবাক হই, সেই বিট্রিশরাজামলে যে সমাজ ও যে জীবন আমি আশৈশব অনুমান করে আসছিলাম। বিভূতিরচনাসম্ভার পড়ে পড়ে প্রযুক্তির শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই অন্যরকম মনে হয় নাই।
অতসী, কুসুম, পদ্মদি আর গোপালনগরের বধূর সুদের বিনিময়ে ব্যবসায় টাকা লগ্নির ব্যাপার টা সেই সময়ে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার প্রবণতা ও প্রচলনকে ইঙ্গিত করে। হ্যান্ডনোটের ব্যবহারও ঋণচুক্তিপত্রর একটা প্রামাণ্য দলিল ছিল বোঝা যায়।
গোপলনগর কৃষ্ণলাল নরেন শ্রীচরণ হরিচরণ বনমালী শ্রীনগর কৃষ্ণনগর রাধাবল্লভ ইত্যার নামকরণের আধিক্য ও প্রবণতা বাঙলাদেশে যে বিষ্ণুকৃষ্ণ ভক্তির আধিপত্য বিরাজমান ইহাকে ইঙ্গিত করে কি?
সারাটা আখ্যানজুড়ে কী নিপুণ দক্ষতার সাথে সহজ বাস্তবতার রেখা ধরে যাচ্চিল। কিন্তু শেষাংশে এসে ভাষার সাধুরূপের প্রয়োগ ও কাহিনীতে অতি নাটকীয়তায় আক্রান্ত হইয়া কোথার যেন একটা ছন্দপতন হইলো।
📘আদর্শ হিন্দু হোটেল
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৪০
Comments
Post a Comment