গোরা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

"বর্ষার সন্ধ্যায় আকাশের অন্ধকার যেন ভিজিয়া ভারী হইয়া পড়িয়াছে। বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন মেঘের নিঃশব্দ শাসনের নীচে কলিকাতা শহর একটা প্রকাণ্ড নিরানন্দ কুকুরের মতো লেজের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে"


স্বগতোক্তি, সংলাপ ও আলংকারিক ভাবনার পাশাপাপাশি জগতের এমন  বিন‍্যাস ও রূপের মনমোহন চিত্রকল্প। এমন গল্প-কাহিনির বর্ণিল আভাস ও প্রতিভাসের ছিহ্ন চিহ্নই তো সন্ধান করিতেছিলাম। অবশেষে সকল পঠন ও পীড়ন পার হইয়া, গোরাতে এসে মিলিলাম।

এক দল লোক সমাজের বাঁধন ছিঁড়ে সব বিষয়ে উল্‌টোরকম করে চলবে আর সমাজের লোক অবিচলিতভাবে তাদের সুবিচার করবে এ স্বভাবের নিয়ম নয়। সমাজের লোকে তাদের ভুল বুঝবেই, তারা সোজা ভাবে যেটা করবে এদের চোখে সেটা বাঁকা ভাবে পড়বেই, তাদের ভালো এদের কাছে মন্দ হয়ে দাঁড়াবেই, এইটেই হওয়া উচিত। ইচ্ছামত সমাজ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার যতগুলো শাস্তি আছে এও তার মধ্যে একটা।"

-সমাজ বিরোধ বা বিদ্বেষ বলি, অথবা পুরাতন অর্গল ভাঙ্গিয়া নবদুয়ারে ডাক বলি। কার্যকারণ সম্বন্ধ ও ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ যে স্রোতস্বিনীর ন‍্যায় ধাবিত হইবে, ইহা সুনিশ্চত। গৌরমহন ও বিনয়ের এই বচসা অত্যন্ত চিন্তাকর্ষক ঠেকিল।

প্রায় সকল উপন‍্যাসে ব্রাহ্মদর্শনের ভাব ও আবেশের একটা আবছায়ার উপস্থিতি একটু পীড়াদায়ক বোধ হইলো। প্রকৃতির ক্রীড়াবৎ এমন পুনরাবৃত্তি কাম‍্য নহে।

চারি দিক তখন মারামারি কাটাকাটি, নিজের প্রাণের ভয়েই মরি– সেই সময় রাত-দুপুরে সেই মেম যখন আমাদের বাড়িতে এসে লুকোল, তুমি তো তাকে ভয়ে বাড়িতে রাখতেই চাও না– আমি তোমাকে ভাঁড়িয়ে তাকে গোয়ালঘরে লুকিয়ে রাখলুম। সেই রাত্রেই ছেলেটি প্রসব করে সে তো মারা গেল।[৬]

১৮৫৮ সালের সিপাহী বিদ্রোহে বিট্রিশ ও ভারতীয় তথা সর্বপক্ষীয়র অগ্নি ইতিহাস নির্ভর এমন দীর্ঘ আখ‍্যান গোরাই কি প্রথম? পাশ্চাত্য কথাসাহিত‍‍্যে রেসিয়াল পাসিং [এক জাত বা বর্ণের ব‍্যাক্তি যখন সঙ্গোপনে অন‍্য জাতি বা বর্ণে অর্ন্তভুক্ত হয়] নির্ভর বহু আখ‍্যান  লিখিত হইয়াছে। হাল আমলে আমেরিকান কথাসাহিত্যিক ফিলিপ রথের The Human Stain, ২০০০ ও ব্রীট বেন্নেতে্র  The Vanishing Half, ২০২০ পাঠ করিয়াছি। আজ পড়িতেছি রবীন্দ্রনাথের গোরা, ১৯১০ [The White Man]। কিন্তু তদসময়ে রবীন্দ্রনাথের জন‍্য বাঙলায় এমন আখ‍্যান অভূতপূর্ব। এই আখ‍্যান বস্তু নিয়া বহুদিন ধরিয়া ভাবিয়া  সময়ক্ষেপণ করিতেছিলাম।

তোমরাই যদি এত উঁচু জাত আর ভগবানের এত আদরের তবে তিনি একবার পাঠানের, একবার মোগলের, একবার খ্রীস্টানের পায়ে এমন করে তোমাদের মাথা মুড়িয়ে দিচ্ছেন কেন?[৬]

তখনকার হিন্দুদের জাত‍্যাভিমান মতোই বর্তমানে মুসলমান মাত্রই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মাধিকারী ; সাদা মানুষ মাত্রই মনুশীরমণি বলিয়া আত্মপ্রচার ও আত্মতুষ্টি আক্রান্ত হইয়া কুম্ভনিদ্রায় শায়িত রহিয়াছে। উভয়ের মধ‍্যকার প্রভেদ মূলত অল্পবিস্তর।

একটি ঘটনা দৃশ‍্য বর্ণনা করিয়া, কয়েকটি দৃশ‍্যান্তর  আবার প্রথম ঘটনার পৃর্বে কি ঘটিয়াছিলো তাহার বর্ণনা বিন‍্যিস ও  কৌশল রবীন্দ্রনাথ পূর্বের উপন‍‍্যাসে ব‍্যাবহার করিয়াছেন উহা প্রচ্ছন্নরূপে চোখে পড়িয়াছে। যেমন বিনয় সচরিতাদের সাথে ব্রাহ্মসভায় গমন প্রথমে, কিন্তু গোরার পরেশ বাবুর বাসায় বিনয়কে খুজিতে যাইয়া পথে উহাদদের সাক্ষাৎ পরে বর্ণন। ঠিক তেমনি বিনয় গোলাপ নিয়া আনন্দময়ীকে নিবেদন পূর্বে, কিন্তু ঐ গোলাপ ললিতা সতীশের মাধ‍্যবে বিনয়কেএ উপহার পরে বর্ণনা। এই কৌশল রবীন্দ্রনাথ বারংবার প্রয়োগ করিয়াছেন।

গোরার জীবনের এই একটা প্রধান ঘটনা একেবারেই বিনয়ের সংস্রব ছাড়া। দুই বন্ধুর জীবনের ধারা এই-যে এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে– আবার যখন মিলিবে তখন কি এই বিচ্ছেদের শূন্যতা পূরণ হইতে পারিবে? বন্ধুত্বের সম্পূর্ণতা কি এবার ভঙ্গ হয় নাই? জীবনের এমন অখণ্ড, এমন দুর্লভ বন্ধুত্ব! আজ একই রাত্রে বিনয় তাহার এক দিকের শূন্যতা এবং আর-এক দিকের পূর্ণতাকে একসঙ্গে অভনুব করিয়া জীবনের সৃজনপ্রলয়ের সন্ধিকালে স্তব্ধ হইয়া অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া রহিল [৩০]

বন্ধুত্বের এমন বিবশমাখা ব‍্যাখা আর কোথাও পড়িয়াছি কি স্মরণে আসিল না। 


মানুষ বস্তুটি যে কত সত্য–আর মানুষ যা নিয়ে দলাদলি করে, ঝগড়া করে মরে, তা যে কত মিথ্যে–সে কথা ভগবান গোরাকে যেদিন দিয়েছেন সেইদিনই বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাবা, ব্রাহ্মই বা কে আর হিন্দুই বা কে। মানুষের হৃদয়ের তো কোনো জাত নেই–সেইখানেই ভগবান সকলকে মেলান এবং নিজে এসেও মেলেন। তাঁকে ঠেলে দিয়ে মন্তর আর মতের উপরেই মেলাবার ভার দিলে চলে কি? [৩৬]

এই সত‍্যখানি অন্তঃকরণ করিবার মতো সদ ঔদার্য যাহার আছে। সেই জন এই বিশ্বসংসারের ভার লাঘবের জন‍্য এক অমূল‍্য সম্পদ।

নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। কেবল ঘটনা থেকে মানুষকে দোষী করবেন না।” [৪৩]

এই ভাব ও বাক‍্যার্থ কোনরূপে যদিবা সকল জনগনমনে রোপণ করিয়া পত্রপুষ্পমূলে বিকশিত হইত। তাহলে দুনিয়ায় ভেদবিভেদের সীমানা ক্রমে সংকুচিত হইয়া আসিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই দাবিটা আজীবন সম্ভবপর হইয়া রহিবে।


সহ্য করার দ্বারা অন্যায়কে যেন স্বীকার করে নেওয়া হয়। অন্যায়কে সহ্য না করাই হচ্ছে তার প্রতি উচিত ব্যবহার।” [৪৪]

আমার দেশ এখন তালবেতাল এই ন‍্যায় অন‍্যায়ের ডামাডোলে।

যেখানে ভিতরে কোথাও একটা অন‍্যায় আছে সেখানে বাইরে শান্তি থাকাটাই সকলের চেয়ে অমঙ্গল।[৪৫]

ঠিক এই কথাখানি আজ শতবর্ষ পরেও ঘরে ও বাইরে লোকজীবন কে ক্রমে ক্রমে উৎকন্ঠিত করিয়া তুলিতেছে।

প্রীতি যদি প্রভেদকে স্বীকার করিতে না পারে, তবে জগতে কোনো প্রভেদ কোথাও আছে কেন?” [৫৮]

বৈচিত্র্যকে স্বীকার করিবার তরে ইহা যেন এক রবীন্দ্রীয় উপপাদ‍্য।

তুমি মনে করছ একটা সীমাবদ্ধ পদার্থকে ঈশ্বর বলে পূজা করা ভ্রম। [৬০]

আকার ও নিরাকার ঈশ্বরের প্রামাণ্য হিসাবে এক সর্ন্দিভবচন এমন করিয়া খুব কমই বলা হইয়াছে।

মানুষকেই সমাজের খাতিরে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে এ কথা কখনোই ঠিক নয়–সমাজকেই মানুষের খাতিরে নিজেকে কেবলই প্রশস্ত করে তুলতে হবে[৬০]

পরেশ কহিলেন, “সমাজের ক্ষয় বুঝতে সময় লাগে। ইতিপূর্বে হিন্দুসমাজের খিড়কির দরজা খোলা ছিল। তখন এ দেশের অনার্য জাতি হিন্দুসমাজের মধ্যে প্রবেশ করে একটা গৌরব বোধ করত। এ দিকে মুসলমানের আমলে দেশের প্রায় সর্বত্রই হিন্দু রাজা ও জমিদারের প্রভাব যথেষ্ট ছিল, এইজন্যে সমাজ থেকে কারো সহজে বেরিয়ে যাবার বিরুদ্ধে শাসন ও বাধার সীমা ছিল না। এখন ইংরেজ-অধিকারে সকলকেই আইনের দ্বারা রক্ষা করছে। সেরকম কৃত্রিম উপায়ে সমাজের দ্বার আগলে থাকবার জো এখন আর তেমন নেই। সেইজন্য কিছুকাল থেকে কেবলই দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে হিন্দু কমছে আর মুসলমান বাড়ছে। এরকমভাবে চললে ক্রমে এ দেশ মুসলমান-প্রধান হয়ে উঠবে, তখন একে হিন্দুস্থান বলাই অন্যায় হবে।” [৬৫]

শেষোক্তি সত‍্যিকারর্থে সকল ভারতভূমে যেন স্পষ্ট করিয়া হিন্দু মুসলিম প্রভেদ ও  অস্তিত্ব রক্ষার আশংকার ব‍্যাপ্তিকে প্রকান্ড করিয়া তুলিল। বঙ্গভঙ্গ ও ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের চরম পর্যায়ে এমন নীতিদীর্ঘ সমীক্ষা একইসাথে বিভাজন ও মৈত্রীর দ্বান্দিক প্রকৃতিকেই ইঙ্গিত করিয়া থাকে। রবিবাবু কী দুঃসাহসিক রূপে এমন আমল পরিবর্তন সঞ্চারক ডায়ালগের অবতারণা করিলেন।

কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তখন মিউটিনি। আমরা এটোয়াতে। তোমার মা সিপাহিদের ভয়ে পালিয়ে এসে রাত্রে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তোমার বাপ তার আগের দিনেই লড়াইয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল– [৭৫]

এই অংশটুকু বোধকরি তখন পর্যন্ত বাঙলা কথাসাহিত‍্য সবচেয়ে সহজ স্বীকারোক্তি। কিন্তু কী গভীর তার দ‍্যোতনা। কী অমোঘ তার ব‍্যাঞ্জনা। এমন ধারনা কল্পনা নিয়ে বাঙলায় যে উপন‍্যাস লিখা হইয়াছে, ইহাই যেন তখন সময়ের জন্যে এক আশ্চর্য!  গোরা কে অতিক্রম করা অসাধ‍্য নহে কিন্তু সুকঠিন বৈকি।

পরেশ কহিলেন, “সত্যকে যখন পাই তখন সে তার সমস্ত অভাব-অপূর্ণতা নিয়েও আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত করে–তাকে মিথ্যা উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তোলবার ইচ্ছামাত্রই হয় না। [৭৬]

এই সহজ সত‍্যের মতোই আখ‍্যানের শেষটা যেন অতি সহজেই শেষ হইয়া গেল।

তবে গোরা-সুচরিতার থেকে ললিতা-বিনয় আখ‍্যানপর্বসমূহ অধিক চিত্তাকর্ষক ও মনোরম বোধ হইলে। এইখানেও রাবন্দ্রীয় কায়দায় যুগল বদল হইয়াছে। কিন্তু পূর্বাপর উপন‍্যাসগুলো থেকে গোরা তুলনামলকভাবে অধিক  বাস্তবঘেষা ও পরিপক্ক। 

রবীন্দ্রনাথই বোধহয় বাঙলায় প্রথম প্রাবন্ধিক আখ‍্যান সৃজন করিয়াছেন।

আবার পড়িতে হইবে অন‍্য ক্ষনে অন‍্য বোধে।




📘গোরা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯১০।




Comments

Popular posts from this blog

The Circus : Charlie Chaplin

La Grande Illusion : Jean Renoir

The 2020 Booker Long List: The Fresh List in the Time of Solitude