আনন্দমঠ : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
আনন্দমঠের সূচনালগ্নে বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং মহামারীর যে লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক বর্ণনা পাঠ করিলাম। তদ্মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির রাজস্ব আদায় এবং মুসলিম রাজসিকদের অবিবেচনাপূর্বক কপটতা ও ভীরুতার ঘটনা জ্ঞাত হইলাম। ইহাতে বারংবার বর্তমানক্ষণের বাংলাদেশের অবস্থার সহিত কয়িদাংশে সাদৃশ্যানুমান করিলে কোন বৃহৎ ভ্রান্তি কিংবা অশুদ্ধ মনে হইবে না।
বৌদ্ধমঠ কি করিয়া মন্দিরে রপান্তরিত হইলো তাহার ইতিহাস ঘাটিয়া দেখিতে হইবে বৈকি। একস্থানেত মসজিদ ভাঙ্গিয়া মন্দির গড়িবার প্রসঙ্গ উপস্থিত। অখন্ড ভারতে সম্প্রীতি অধিক বিদ্বেষপূর্ণ ছিলো কি? তানাহলে এতো দ্বন্দ্ব এতো ভাঙ্গন হইতো কি?
পলাশীর পরাজয়ের পর ভারতমুক্তির নিমিত্তে সাধারণজনগণ কি করি সন্ন্যাস বসনে (বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণবগণ ও কালীদেবীঅন্তপ্রাণ/রাজবিদ্রোহী/ছেলেধরা) কঠোর তপস্যায় সন্ন্যাসী আন্দোলন গড়িয়া তুলিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে ইহা মুসলিম বিদ্বেষ বা হিন্দু জাতীয়তাবাদে ( সত্ব-চৈতন্যপ্রেমভক্তি, রজঃ-ধর্ম ও জাত রক্ষার্থে যুদ্ধ; তমঃ- মুর্তিপূজাউপাসনা)
প্রতিভাত হইলো তাহা এক বিস্ময়কর বিষয় বোধহয়। গ্রন্থোল্লেখিত দুষ্টের দমন শিষ্ঠের পালন -এই আপ্তনীতি বাক্যেকে দ্বান্দিক ও ভ্রান্তিপূর্ণ করে তোলে।
আনন্দমঠ আখ্যানে বন্দে মাতরম সৃজনের প্রত্যক্ষ প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে জানিতে পারিয়া প্রীত হইলাম।
কল্যাণী ও সুকামারীর অতিনাটকীয় আকস্মিক মৃত্যু বঙ্কিমবাবুর এক নিজস্ব শিল্পকৌশল। এইরূপ কৌশলাফলম্বন করিয়া তিনি বিষবৃক্ষের কনন্দুওকে মারিয়াছেন। আজকের সাহিত্যির শিল্পবিচারে আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য। তৎকালীন পাঠককুল ইহাকে কিরূপে গ্রহণ করিয়াছেন সন্ধান করিতে হবে।
শেষাংশে হিন্দুরাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিতার নিমিত্তে ব্রিটিশ উপনিবেশি কতকাংশ অত্যাবশকীয় বলিয়া যে অভিমত ব্যপৃত হইয়াছে তাহা আমার চিত্তকে বিস্ময়াভূত করিয়াছে। ভারতে মুসলমান রাজত্বও যে এক অতিদীর্ঘ উপনিবেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়া ছিল এবং উহার সমাপ্তি ঘটিয়াছে সিপাহি বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে ইহাই কেন বা হিন্দুদের মনে স্বস্তি আনিয়া দিয়াছিল। সত্যিই কি সনাতনানুসরীরা তাহা মনে করিতো। ভাবিয়া দেখিতে হইবে বইকি!
যুদ্ধের সমাপ্তিতে একদিকে ভূখন্ড হয়তো জয় লাভ করা যায়; অন্যদিকে পরাজয় হয় মানুষের।
📙আনন্দমঠ (১৮৮২)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্গদর্শন, ১২৮৭বাং
Comments
Post a Comment