বিষবৃক্ষ : বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
র্জামান (ডয়েচে) ভাষার মতো বিশেষ্য-বিশেষণ-ক্রিয়া-অব্যয় পদসংযোগে অতিদীর্ঘশব্দবন্ধনীর পুনঃপুন ব্যবহার দেখিয়া অতি প্রীত হইলাম। তবে ইহা কি সংস্কৃতবৎ অথবা বাঙলার স্বীয় ব্যাকরণ তাহা অজ্ঞাত রহিয়া গেলো। যেমন:
সান্ধ্যগগনশোভিরক্তাম্বুদতুল্যবর্ণবিশিষ্ঠা (সন্ধ্যার আকাশে রক্তলাল মেঘের রঙের মতো)!
বঙ্কিমবাবুর বর্ণনাভঙ্গিতে কোনরূপ ঘটনার অগ্রবর্তীআভাস প্রদান করিবার যেরূপ কৌশল প্রয়োগ করিয়া থাকেন তাহা পাঠের স্বাভাবিকগতি কিঞ্চিৎ শ্লথ করিয়া দেয় এবং তৎসহকারে পরবর্তীকাহিনীরকোমলতাকে কেমন প্রস্তরখন্ডের ন্যায় অমসৃন করিয়া তোলে। সেইরূপে সংলাপে নাট্যবৎ আকার ব্যবহার কিঞ্চিৎ পদাবিদ্ধকন্টকন্যায় ক্লেশের উদ্ভব হইয়া থাকে।
ভাবিয়াছিলাম "পদপলাশলোচন" শব্দগুচ্ছ কমলকুমারের স্বীয় সৃষ্টি। কিন্তু বঙ্কিমবাবুর বিষবৃক্ষ পড়িতে আসিয়া অবগত হইলাম "পদ্মপপলাশনয়ন" শতবর্ষপূর্বেই ব্যবহৃত হইয়া আছে। তদরূপ বাঙলার অন্তর্বর্তী English scripts প্রত্যক্ষরূপে এবং সমভিব্যাহার বঙ্কিমমশাই পূর্বকালে করিয়া গিয়াছেন। উহা সম্বন্ধে অদ্যবদি আমি একপ্রকার অন্ধাবিষ্ঠ ছিলাম।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে কালিদাসের মেঘদূতম কাব্যের স্বর্গসিড়ির পরোক্ষোল্লেখ কিয়দাংশ অনাহূত ও বেমানান লাগিল। কিন্তু অভিজ্ঞাত হইয়া কিয়দপরিমাণ বিস্ময়াভূত হইলাম।
"যখন রাধে বলে বাজে বাশীঁত
খন নয়নজলে আপনি ভাসি।"
হরিদাসী বৈষ্ণবীর গাওয়া কীর্তনের এই চরনদ্বয় তৎকালীন কথ্যরূপ সমন্ধে সম্যক ধারনা পরিস্ফুটিত হয়। আখ্যানে সঙ্গীতের সামঞ্জপূর্ণ ব্যবহার বঙ্কিম-কমলকুমার-আখতারুজ্জামান-জহির অনন্য পারঙ্গমতায় প্রয়োগ করিয়াছেন। তাহাদের পরিমতবোধ উপন্যাসগুলোকে গীতাখ্যানে পর্যবসিত হইবার কড়ালহস্তমুষ্ঠি হইতে রক্ষা করিয়াছেন।
তৎকালীন নারীস্বাধনতা (বিধবা বিবাহ) ও ধর্মসংস্কার (ব্রাক্ষ্রসমাজ) সম্বন্ধে যেমত প্রচেষ্টা এবং কপটতা বিদ্যমান ছিলো বঙ্কিম যেন তদ্বিষয়ে একখানি হ্রসসমীক্ষা রচনা করিলেন। নগেন্দ্রবাবুর প্রত্রাযুক্তিতে সন্তানাদিরবংশপরিচয় সম্বন্ধে বিধবা বিবাহ আর বহুবিবাহের আলেখ্য বর্তমান সমাজেও সমভাবে বিরাজমান। কিন্তু যে নারীর সন্তান হইবে না কিংবা নিঃসন্তান থাকিতে মনোবাসনা পোষণ করিয়া থাকে তাহাদের কিরূপ বিধান তদ্বিষয়ে কোন আলোচনা তৎকালীন এবং অদ্যকালেও উত্থাপিত হইয়া থাকে না।
প্রেম ও পরকীয়ার বিষবৃক্ষ পাঠান্তে কৈশোরবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথের চোখের বালির আবেশ যেন পুনরায় আমার মনোভূমিমাঝে জলের উপর শীতসমীরণের পরশ বহিয়া গিয়াছে।
বোধধুদ্ধিজড়িত প্রণয়বাসনা যেন অনন্তবর্ষেরঅমৃতসম আর রূপদর্শনজনিত প্রণয়কামনা যেন মুহূর্তকালস্থিতবিষবৃক্ষসম।
"সকল সুখেরই সীমা আছে" ; আশা ফুরাইলেই সব ফুরাইলো" কেমন করিয়া শঙ্খধ্বনিবৎ কর্ণগহ্বরে বাজিয়া চলিয়াছে।
📙বিষবৃক্ষ (১৮৭৪)
বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্গদর্শন প্রথমসংখ্যা (বৈশাখ সংখ্যা ১৮৭২)
Comments
Post a Comment