রজনী : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

মানবমনের বাহান্ন বাজার তেপান্ন গলি চক্রাকারে ঘূর্নিবৎ ঘুরিয়া আসিলেই কেবল রজনী সৃজনসম্ভবপর হইয়া উঠে।

প্রভাতের প্রথমঅরুণরশ্মিরন‍্যায় ইহা পরিস্কার যে বঙ্কিম তাহার সমসাময়িক দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাহিত‍‍্যিক মতবাদসমূহ সম্বন্ধ যেরূপ অবগত ছিলেন তেমনি প্রাচীন গ্রীক, ভারতীয়, পারস‍্য ও রোমান সাম্রাজ্যসমহের ঐশ্বর্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলে।

বাঙ্গলাসাহিত‍্যের প্রারাম্ভে তিনি বহুস্বারিক কথাসাহিত‍্য সৃজন করিয়াছেন। এক একটি চরিত্রের স্বগতোক্তি দ্বারা আখ‍্যানিকাটি প্রণীত হইয়াছে। অর্ধাংশর অধিক শুধুমাত্র চরিত্রাবলীর মনোজগতে চলমান ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সমুদ্রউর্মিমালাবৎ বহিয়া গিয়াছে।

দার্শনিক মৌলিকপ্রশ্নালী যেন উপন‍্যাসের পৃষ্ঠে পৃষ্ঠে মধুপক্ষিন‍্যায় গুঞ্জরিত হইতে লাগিলো। এইরূপে বাঙ্গলায় আর কোন উপন‍্যাস রচিত হইয়াছে কিনা সংশয় রহিয়া গেলো।

::: "তোমাদের সুখদু:খে আমার সুখদু:খ পরিমিত হইতে পারে না। তোমরা আর আমি ভিন্নপ্রকৃতি।"

[ মানবপ্রকৃতির প্রভেদের দরুণ নৈতিক মানদন্ডে সুখবাদ একটি আপেক্ষিক বিষয়। যাহা বেন্থাম ও মিল থেকে ভিন্নরূপে ব‍্যাখ‍্যাত হইলো]

::: "তোমাদের জীবন দৃষ্টিময়-আমার জীবন অন্ধকার-দু:খ এই, আমি ইহা অন্ধকার বলিয়া জানি না। আমার এ রুদ্ধ নয়নে, তাই আলো! না জানি তোমাদের আলো কেমন!"

[ হুর্সালে রূপত্তবিদ‍্যা আমাদের সংবেদন ও প্রত‍্যক্ষণ কিভাবে জ্ঞান হিসাবে পরিগ্রহ লাভ করে]

::: জীবের এত কষ্টে দেবতার কি সুখ? কষ্ট দিবার জন্য সৃষ্টি করিয়া কি সুখ? মূর্তিমতী নির্দয়তাকে কেন দেবতা বলিব? কেন নিষ্ঠুরতার পূজা করিব?

[নৈতিককর্মনির্ধারণ ও র্ধম্মপালনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে এক সংশয়বাদী চেতনা ]

::: "সুখদু:খ পরের হাত, না আমার নিজের হাত? পর কেবল বহির্জগতের কর্তা-অন্তর্জগতে আমি একা কর্তা। "

[ব‍্যাক্তিস্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্রনবাদ কিভাবে আমদদের নৈতিক কর্মপন্থা নির্বাচনে সহায়তা করিয়া থাকে ]

::: "আমার কাম্য বস্তুর অভাবই আমার দু:খ। আমি বুঝিয়াছি যে, সকলই অসার। তাই আমার কেবল দু:খ সার।"

[ বৌদ্ধদর্শনের জীবনের মোক্ষ নির্ধারণ ও অর্থ প্রতিপাদন ]

::: "আমার যোগ্য কাজ আমি খুঁজি, যাহাতে আমার মন মজিবে, তাই খুঁজি।"

[ সার্ত্রমতে অস্তিত্ব যে সারস্বত্তার পূর্বগামী তাহারই পরোক্ষ বচন যেন]

::: "যাহা বাক্য এবং কার্যদ্বারা চিত্রিত হইয়াছে, তাহা চিত্রফলকে চিত্রিত করিতে চেষ্টা পাওয়া ধৃষ্টতার কাজ। সে চিত্র কখনই সম্পূর্ণ হইতে পারে না ; এবং এ সকল চিত্রও সম্পূর্ণ নহে।"

[ সৌন্দর্যত্ত্বর  শিল্প ও সৌন্দর্যমূল‍্যায়ণে গ্রাফিকসাহিত‍্য সমালোচনা করিয়িছেন]

যাহার ক্রিয়া দেখি, তাহাকেই মানিব। যাহার কোন চিহ্ন দেখি না, তাহাকে মানিব কেন? materialism

মন ও শরীর এক। শরীর ও মনের প্রভেদ কেন মানিব? যে কিছু কার্য করিতেছ, সকলই শরীরের কার্য-কোন‍্‍টি মনের কার্য? 

[ প্লেটো হইতে দের্কাদ অবধি শরীর ও মনের বৈশিষ্ট্য নিয়া যে অমীমাংসিত আলোচনা তাহার ভিত্তিতে ভারতীয় দর্শনের দেহ-মনের একত্ববাদের প্রতিধ্বনি যেন]

::: "যাহা ইংরেজেরা জানে, তাহাই সত্য, যাহা ইংরেজ জানে না, তাহা অসত্য, তাহা মনুষ্যজ্ঞানের অতীত, তাহা অসাধ্য। বস্তুত: তাহা নহে। জ্ঞান অনন্ত। কিছু তুমি জান, কিছু আমি জানি, কিছু অন্যে জানে, কিন্তু কেহই বলিতে পারি না যে, আমি সব জানি-আর কেহ আমার জ্ঞানের অতিরিক্ত কিছু জানে না।"

[ আপেক্ষিক জ্ঞানকাণ্ডের এক অমোঘ উক্তি উচ্চারিত হইলো এইখানে]

:::: "হৃদয়স্থ লুক্কায়িত এবং অপরিচিত ভাব বা প্রবৃত্তি সকল প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং অত্যন্ত বলবান হইয়া উঠে।"

[ ফ্রয়েডীয় অবচেতন মনোস্তরের সচ্ছ প্রতিফলিন যেন এই বচন]

অন‍্যান‍্য সকল উপন‍্যাসের মতো এই রজনীও ত্রিকোণীপ্রেমের শৃঙ্খল হইতে বঙ্কিমচন্দ্র মুক্তিলাভ করিলেন না। প্রেমাঙ্গিকের এই পুনরাবৃত্তি একপ্রকার অম্বলন‍্যায় বিস্বাদ হইয়া উঠিয়াছে। সাহিত‍্যিককল্পনাশক্তিকে আরো একটি বক্রপথে বা বাস্তবতার প্রস্তরকঠিনতায় হাটাইয়া আনিলে কিয়দ ভিন্ন স্বাদ লাভ করিতে পারিতাম।




📘রজনী

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 

বঙ্গদর্শন, ১৮৭৫ ইং


Comments

Popular posts from this blog

The Circus : Charlie Chaplin

শুদ্ধ দেশ: পলাশ মাহমুদ

As breezes flowing low : Palash Mahmud