রাজসিংহ : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 

হিন্দুরাজার তসবির আছে?
এ সকল হিন্দু নয়, ইহারা মুসলমানের চাকর। (মানসিংহ, বীরবল)

মোগল শাহজাদার ঔরঙ্গজেবের তসবিরের মুখপৃষ্ঠে রঙ্গরসপ্রিয়া রাজকন‍্যা চঞ্চলকুমারীর পদাঘাত কি শুধু মুসলমানবিদ্বেষই একক হেতু? নাকি রাজঅসন্তুষ্ঠিও উহার পশ্চাদাকরণ? ইহাকি শুধুই আখ‍্যাণচরিত্রাবলীর স্বাভাবিক ভাবাবেশ নাকি লেখকের তৎসময়ের হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু তৎপরবর্তী পরিচ্ছদে রাজসখী নির্ম্মলকুমারীর ঔরঙ্গজেবকে বিবাহ করিবার প্রাণত্মক অভিলাষ ও তাহাকে হিন্দুতে রূপান্তর (বেড়াল ইন্দুর ভজে যেমন) করিবার সুদৃড় অঙ্গীকার দ্বারা জাতীয়তাবাদী প্রপঞ্চই যেন প্রতিষ্ঠা পাইবার পথ খুজিঁয়া পাইলো।

প্রথম খন্ডের চতুর্থ পরিচ্ছেদ পাঠপূর্বক আমার মনোঅরণ‍্যমাঝারে প্রভাতের প্রথম আলো প্রবেশ করিলে কিংবা অসাড় মধাহৃে   কোকিলসুরের মিষ্টলহরী  বাজিয়া উঠিল।
সাহিত‍্যে বহুভাষার সামঞ্জস‍্যপূর্ণ ব‍্যবহার বরাবরই আমাকে কনকবর্ণ হরিণশাবকবৎ আকৃষ্ট করিয়া থাকে। চিত্রবিক্রেতা বুড়ির সাথে উহার পুত্র খিজর সেখের হিন্দি ভাষায় কথোপকথন প্রত‍্যক্ষরূপে বাঙলা বর্ণান্তরণ পড়িয়া আমি বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হইলাম। এইরূপ আলংকারিক কৌশল তৎসময়ে প্রয়োগ করা হইয়াছে ভাবিয়া চমকিত হইলাম। যদিওবা আমি তলস্তয় যেরূপ যেরূপে ওয়ার এন্ড পীস মহাআখ‍্যানে ফরাসি ভাষা ব‍্যবহার করিয়াছিলে আমিও সেইরূপ ব‍্যবহারে পক্ষপাতী। কিন্তু বাঙলার সাথে কিরূপে ব‍্যবহার করা যায় তদবিষয়ে দীর্ঘকাল ধরিয়া ভাবিয়া মরিতেছি।

তদকালে দরিয়া বিবির কথা বেচার কারবার কিংবা ইহাকে যে জীবিকা নির্বাহ করিবার উপায়াবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করা যায় তাহা ভাবিয়া কৌতুকমিশ্রিতশ্লেষ অনুভূত হইলো।

দ্বিতীয় খন্ডের শিরোনাম "নন্দনে নরক" হইতে কি হুমায়ূন আহমেদ তাহার প্রথম উপন‍্যাসের নামকরণ করিয়াছিলেন!?

দিল্লীনগরের কুতুবমিনার, চার মিনার, চাঁদনী চৌকের প্রদীপ্ত বিভাময়ী আবহকে নরকের নন্দন বলিয়া সম্ভাষণ  তো আখ‍্যানের কথক করিয়াছেন; ইহাতেও কি ক্ট্টর এবং বিদ্বেষপ্রসূত জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক প্রত‍্যয়ের ভিত বলিয়া জ্ঞান করিবো না অগ্রবর্তী হইয়া আরো নির্মোহসহকারে পর্যবেক্ষণপূর্বক বিবেচনা করবো?

বাঙলা উপন‍্যাসে টীকাভাষ‍্যর ব‍্যবহার এই প্রথম লক্ষ‍‍্য করিলাম। পূর্ব্বকালীন করিইয়াছি কিনা তাহা মনে করিতে পারিতেছি না।

দিল্লীর রাজরঙমহার ( অন্তঃপূরম) কে ঐশ্বর্ষ‍্য-নরক অভিধা করিয়া বলিলেন- "এতো মহাপাপ আর কোথাও নাই"। এতো ক্ষোভ আর দ্রোহের বহিঃপ্রকাশের কি কারণ তাহার সত‍্যতা কি ইতিহাস খুড়িলে পাওয়া যাইবে? না সাহিত‍্যে শৈল্পিক সত‍্যতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে?

হিন্দু রাজপুত্রী চঞ্চলকুমারী ও যোধপুরী রাজকন‍্যা একদিকে সুশীলা ও ধর্ম্মরক্ষণী, অন‍্যদিকে মোগল শাহজাদীঁ জেব-উন্নিসা ও দারশিকো, ঔরঙ্গজেবের জর্জিয়ান উদীপুরী বেগম কুশীলা ও গণিকান‍্যয় বলিয়া বর্ণীত করিয়া শ্রীবঙ্কিমবাবু কি তাহার অনন‍্যপূব নারীচরিত্র সৃজনশীলতার দ্বারে প্রস্তরের কাষাঘাত করিলেন? কিন্তু এই মনোবৃত্তি কি তাহার লেখকসত্বার সত‍্যমূল‍্যের বিসর্জন নয়?

অব‍শ‍্য পূর্ব্বপঠিত র্সূর্যমুখীর, কল‍্যাণী, কপালকুন্ডলা এবং তিল্লোত্তমার বিপরীতে যেমন মতিবিবি/পদ্মাবতীকে অনেকাংশে কুটিল ও খলচরিত্র বলিয়াই এখন প্রতিভাত হইতেছে।

চঞ্চলকুমারীর পত্র পড়িবার মাত্র একদিকে স্মরণে আসিল রাজসিংহকে কি দুর্গেশনন্দিনীর ক্রমপর্ব বলা যায়? অন‍্যদিকে এক প্রচ্ছন্ন অনুমাণ মানসপটে উদিত হইলো এই যে- ভূভারতে মুসলমান ধর্ম্মবিস্তার আর মোঘল-পাঠান শাসনকে সাম্রাজ্যবাদী বা উপনিবেশবাদ অভিধায় ইউরোপিয়ান উপনিবেশের মতো সম‍রূপে নিন্দনীয় রূপে গ্রহণ করা হয় কি? এই সম্বন্ধবিবেচনা করিয়া বঙ্কিমবাবুর খাঁ-শাহবিদ্বষের পূর্ব্বমত কটাক্ষ কতক যৌক্তিক তাহার বিচারকার্য ভবিষ্যতর তুলিয়া রাখিলাম।

মোঘল ঔরঙ্গজেবের হিন্দুবিদ্বেষবশবর্তী হইয়া যদি হিন্দুনিধণ, গোহত‍্য, জেজেয়া বা দেবালয়বিনষ্টকরণ ইত‍্যবৎকার কার্যসংঘটিত হইয়া থাকে তাহলে এ মহাক্রান্তিকাল কিরূপ ফণীবিষস্বরূপ ছিলো তাহা বতর্মানকালীন হিন্দুস্থানের মুসলমান সহিত যাহা করিতেছে তাহার ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়।

মেসোপটেমিয়া কুরুক্ষেত্রে বহুজাতিক দুর্দশা বিশেষত বাঙালি পল্টন নিয়ে আমার বহুপ্রত‍্যাশিত উপন‍্যাস লিখিবার জন‍্য বহুদিবসরজনীধরিয়া সমরক্ষেত্রে রিট্রীট, সীজ, আর্মস্টিস, মার্চ ও যুদ্ধবন্দী সম্বন্ধে বাঙলায় সমরূপ ক‍োন লেখার সন্ধানে ছিলাম তাহা আজ রাজসিংহপাঠে সামান‍্য দেখিতে পাইলাম।

রাজসিংহ পড়িয়া শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বলিয়া যে অপবাদ আরোপ করিয়া আসিতেছিলাম তাহাকে মানবধর্ম্মশূন‍্যতার বাস্তবিক চিত্রায়ন ও করুন পরিণতি হিসাবে দেখিয়াছেন বলিয়া শ্রদ্ধাভরে স্বীকারোক্তি দিয়াছেন। এতদবিষয়ে তিনি স্পেন ও মোগল স্রামাজ‍্যর পতনের এক অনিবার্য কারণাদির তুলনা উপস্থাপন করিয়াছেন যাহা অলঙ্ঘ‍্যনীয়।

উপন‍্যাসের বর্ণনাভঙ্গিতে লেখক বা গল্পকথক পাঠককে যে প্রতক্ষরূপে সম্ভাষণ করে উনার মতামত বা কৈফিয়ম প্রদান করে এই কৌশলখানি সাহিত্যমূল‍্যকে কিয়দাংশ ক্ষুদ্র করিয়া তোলে।



📘রাজসিংহ  (১৮৮৪)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্গদর্শন, ১২৮৪।

Comments

Popular posts from this blog

The Circus : Charlie Chaplin

La Grande Illusion : Jean Renoir

The 2020 Booker Long List: The Fresh List in the Time of Solitude